“ওরে বাপু, অ্যারেস্ট হলে যে প্রেস্টিজ বাড়ে। তার উপর ডাকাতির কেস। কী বলিস রে নসে?”
নসিবাবুও কথাটা সমর্থন করলেন। কাণ্ড দেখে কাশীবাবু এতটাই মর্মাহত হলেন যে, এই ঘটনার দিন দুই পর তিনি নিজে উকিল হয়েও একজন বড় উকিলের কাছে গিয়েছিলেন, বাবা আর দাদুকে ডিভোর্স করার কোনও আইন আছে কিনা জানতে। উকিল দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে জানিয়েছিলেন, “না, নেই। ইহজন্মে বাপ-দাদার সঙ্গে সম্পর্ক কোনওক্রমেই নাকি ছাড়ান-কাটান করা সম্ভব নয়। এমনকী মরার পরও তারা পিছু ছাড়েন না। সারাজীবন এঁটুলির মতো লেগে থাকেন।”
তবে হ্যাঁ, কাশীরামের প্রতি শশীবাবু এবং নসিবাবুর আগেকার নাক সিঁটকনোর ভাবটা আর নেই। তারা এখন কাশীরাম কাছে এলে সপ্রশংস চোখে তাকান এবং কাশীবাবু কোনও কথা বললে আগেকার মতো উড়িয়ে না দিয়ে গুরুত্ব সহকারে শোনেন। গাঁয়ের মাতব্বরদের মধ্যেও বিপুল পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা এখন কাশীবাবুকে দেখলেই শশব্যস্তে ভাল তো বাবা’, সব ঠিক আছে তো বাবা’, ‘কোনও অসুবিধে হলে বোলো বাবা’ বলে কুশলপ্রশ্নাদি করে থাকেন। বাজারে গেলে দোকানিরা অন্য খদ্দেরদের উপেক্ষা করে কাশীবাবুকেই আগে জিনিস দেয়। দ্বিজপদ একদিন শশব্যস্তে এসে বলল, “খবর শুনেছেন কাশীদা! আপনার ডাকাতির খবর শতগুণ করে কে বা কারা গিয়ে বিজয়বাবুকে বলে বিয়েটা ভন্ডুল করার উপক্রম করেছিল। বিজয়বাবুও বিয়ে ভাঙার তোড়জোড় করছিলেন। কিন্তু কী কাণ্ড! কুঁচি সাফ বলে দিয়েছে, বিয়ে করতে হলে কাশীরামকেই, আর কাউকে নয়। সামনের শুক্রবার বিজয়বাবু আপনাকে আশীর্বাদ করতে আসছেন।”
দিন পনেরো পরে, এক সকালে কাশীবাবু খুব মন দিয়ে তাঁর বাগানে একটা বিরল প্রজাতির গোলাপ গাছের কলম লাগাচ্ছিলেন।
হঠাৎ নরহরি বলে উঠল, “ওই যে আবার এসেছে! এবার কী বিপদ হয় কে জানে!”
কাশীবাবু অন্যমনস্ক গলায় বললেন, “কে রে?”
“ওই যে দেখুন না?” কাশীবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, ফটকের কাছে খাঁদু গড়াই দাড়িয়ে। তেমনই উলোঝুলো পোশাক, হাড়হাভাতে চেহারা। মুখে গ্যালগ্যালে হাসি, চোখে চোখ পড়তেই ভারী আপ্যায়িত হয়ে বলল, “নাঃ, বাগানখানা বড় সরেস বানিয়েছেন মশাই।”
কাশীবাবু হাত ঝেড়ে উঠে পড়ে বললেন, “এ আপনার ভারী অন্যায় খাঁদুবাবু! না হয় আমাদের মস্ত উপকারই করেছেন, তা বলে নিজের পরিচয়টা আজ অবধি দিলেন না, এটা কি ভাল হচ্ছে?”
খাঁদু গড়াই জিভ কেটে ভারী কাচুমাচু হয়ে বলে, “ওকথা কবেন না। পরিচয়টা পাঁচজনকে বলার মতো নয়। তবে চাপাচাপি যদি করেন, তা হলে চুপিচুপি বলছি মশাই, আমি হলুম গে দয়ালহরি গড়াইয়ের ছেলে, রাখালহরি গড়াইয়ের ভাইপো শ্ৰীক্ষুদিরাম গড়াই। লোকে খাঁদু বলেই জানে।”
কাশীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “ওতে আর ভবি ভুলছে না। তা না হয় আসল কথাটা না-ই বললেন। আপনি হয়তো স্পাইডারম্যানই হবেন। কিংবা কে জানে, সুপারম্যানও হতে পারেন। কিন্তু আজ আপনার সঙ্গে আমার অনেক আলোচনা আছে। আজ ছাড়ছি না আপনাকে। সেই যে নীলপুরের জঙ্গলে মাঝরাতে এসে ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে, সেই ব্যাপারটা আজ আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি মশাই।”
“সে না হয় হবে। কিন্তু সাতসকালে উঠে খালি পেটে সেই বিষ্ণুপুর থেকে তিন মাইল ঠেঙিয়ে আসছি মশাই, মানুষের খিদে-তেষ্টা বলেও তো একটা কথা আছে।”
কাশীবাবু হেসে ফেললেন, বললেন, “ও নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে। ভিতরে আসুন তো, জুত করে বসি।”
তারপর, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে নিয়ে দু’জনের মধ্যে ঘোরতর আলোচনা হতে লাগল।
.
তা সে যাই হোক, আসল কথাটা হল, মহিষবাথানের জঙ্গলে আর নীলপুর অরণ্যে আগে অনেক ডাকাত ছিল। এখন আর ডাকাত নেই।