“যে আজ্ঞে। সকালে যখন ঘুম ভাঙবে তখন ঠান্ডা মাথায় কথাটা ভাল করে ভেবে দেখবেন।”
মাইল দশেক দূরে থানায় নিজের চেয়ারে কেতরে বসে কানাইদারোগা হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন। সদর থেকে হুকুম এসেছে আজ থানায় সবাইকে রাতে তৈরি থাকতে হবে। হঠাৎ চমকে উঠে খাড়া হয়ে বললেন, ঘরে কে একটা ঢুকেছে। মোটা রুলটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, “কে তুই?”
খাঁদু গড়াই হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বিগলিত হেসে বলে, “দণ্ডবৎ বড়বাবু, এই কাগজখানা দেখাতেই আসা।”
বলে সে একখানা চিরকুটের মতো জিনিস এগিয়ে দিল। সেটা পড়ে কানাইদারোগা বলে উঠল, “বাপ রে! আপনি?”
“ঘাবড়াবার দরকার নেই। সর্বত্র স্প্রে করা আছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনও অসুবিধে হবে না। শুধু গতরখানা নাড়লেই হবে।”
“যে আজ্ঞে।” বলে কানাই শশব্যস্তে বেরিয়ে পড়ল।
খাঁদু গড়াই বাইরে এসে ইদিক-উদিক একটু দেখে নিয়ে অন্ধকারে সুট করে সরে পড়ল।
৭. সকালে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে
সকালে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে ঝড়াক করে কথাটা মনে পড়ে গেল। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে। কাশীবাবু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলেন, আচ্ছা, শুধু একথাটা বলার জন্য খাঁদু গড়াইয়ের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অত কষ্ট করে মাঝরাতে এসে হানা দেওয়ার কোনও মানে হয় ? জলবতরলং একটা কথা, ঘোরপ্যাঁচ নেই!
তবে কাশীবাবু ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতে উঠে বাইরে এলেন। গাছগাছালির ফাক দিয়ে সূর্যোদয় দেখতে দেখতেই ভাবতে লাগলেন। হ্যাঁ, কথাটা হল, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে। তা কথাটার মধ্যে প্যাঁচটাই বা কোথায়, ধরতাই বা কোথায়! কাশীবাবু প্রাতকৃত্যাদি সারলেন এবং সারতে সারতেও ভাবতে লাগলেন। আচ্ছা জব্বর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে তো খাদু! মাছির মতো ঘুরে ঘুরে এসে মাথায় বসছে। জ্বালাতন আর কাকে বলে!
ভারী নির্জন বনভূমি। ভারী শান্তি। ভারী আরাম। ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর হঠাৎ কাশীবাবুর চটকা ভাঙল। তাই ততা! এরা সব গেল কোথায়? চারদিকে কোথাও কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তো! এত নির্জন, এত শান্ত তো মনে হওয়ার কথা নয়!
কাশীবাবু তাড়াতাড়ি গিয়ে হাবু আর সনাতনের তাঁবুতে উঁকি মারলেন। কেউ নেই। তারপর এ-তবু সে-তাবু, সর্বত্র গিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখলেন। কোথাও কেউ নেই। এমনকী খুড়োমশাই রাখালহরির ছাউনি পর্যন্ত ফঁাকা। দু’দুটো রাঁধুনি এ-সময়ে গোছ গোছা রুটি বানাতে গলদঘর্ম হয়। দু-দুটো জোগালি তাল তাল আটা মাখতে হিমশিম খায়। কিন্তু তারা কেউ নেই। উনুন নেভানো। গাছে বসে যারা দিনরাত পাহারা দেয়, তাদের কারও টিকিটিও খুঁজে পেলেন না কাশীরাম। তবে কি আজ সকালেই কোথাও বড় ডাকাতিতে বেরিয়ে পড়ল সবাই? তাই বা কী করে হবে! সবাই মিলে একসঙ্গে তো কখনও যাওয়ার নিয়ম নেই। ঠেক তা হলে পাহারা দেবে কে?
কাশীবাবু ভারী তাজ্জব হয়ে গেলেন। আশ্চর্যের বিষয়, কারও তাবুতে একটাও অস্ত্রশস্ত্র পড়ে নেই। গোটা জায়গাটা হাঁ-হাঁ করছে ফঁাকা।
চোখ কচলে এবং গায়ে চিমটি দিয়ে স্বপ্ন দেখছেন কিনা পরীক্ষা করলেন কাশীবাবু। না, জেগেই আছেন। জেগে থাকার আরও একটা লক্ষণ হল, তার খিদে পাচ্ছে। কিন্তু খাবারদাবারের কোনও জোগাড়ই নেই। ভারী বেকুবের মতো কাশীবাবু এ-তাবু থেকে সে-তবু ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আর তার মাথার মধ্যে সেই কথাটা ঘুরে ঘুরে মাছির মতো বসতে লাগল বারবার, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে।।
খিদে চড়ে গেলে কাশীবাবুর মাথার ঠিক থাকে না। তাই কাশীবাবু ভারী হতাশ হয়ে মাটিতে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন। এমন সময় জঙ্গলের রাস্তায় ঘরঘর শব্দ তুলে একটা জিপগাড়ি এসে দাড়াল। ভারী বিরক্ত মুখে কানাইদারোগা গলা বাড়িয়ে বললেন, “চটপট উঠে আয় তো! হাতে মোটেই সময় নেই। মরছি নিজের জ্বালায়, তার উপর আবার এইসব উটকো ঝামেলা।”
কাশীবাবু দ্বিরুক্তি না করে জিপে উঠে পড়লেন।
কানাই আঁশটে মুখ করে বলেন, “মাথা খারাপ না হলে কেউ দশ মাইল হেঁটে জঙ্গলে মর্নিংওয়াক করতে আসে?”
“মর্নিংওয়াক! কে বলল মর্নিংওয়াক?”
“তাই তো বলল।”
“কে বলল?”
কানাই খিচিয়ে উঠে বলেন, “তোর অত খতেনে দরকার কী? বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা, দিচ্ছি।”
কাশীবাবু আর কথা কইতে সাহস পেলেন না।
বাড়ির ফটকের কাছেই শশীরাম আর নসিরাম দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। জিপটা এসে থামতেই কাশীরামকে প্রায় ঠেলে জিপ থেকে নামিয়ে দিয়ে কানাইদারোগা শশীবাবুকে বললেন, “এই নিন আপনার আদরের নাতি।”
শশীবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, “এটা কী হল হে কানাই, তুমি কাশীকে অ্যারেস্ট করলে না যে বড়? আঁ! ব্যাপারটা কী?”
কানাই হাতজোড় করে বললেন, “আমাকে মাপ করবেন শশীবাবু। ওটি পারব না। আমাদের পাঁচ-পাঁচটা থানার লকআপে ঠাসেঠাস ভরতি। চার জনের সেল-এ চল্লিশ জনকে পোরা হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের লিস্টে কাশীরামের নামও নেই।”
“নেই মানে? নেই বললেই হবে? জলজ্যান্ত আমাদের চোখের সামনে ডাকাতি করেছে, আর তুমি বলছ লিস্টে নাম নেই?”
“মশাই, শুধু নিজের কথাই ভাবছেন, একটু পুলিশের কথাও ভাবুন। আপনার মায়া হয় না পুলিশের জন্য? একশো-দেড়শো দাগি ডাকাত নিয়ে আমরা এখন হিমশিম খাচ্ছি, আর আপনি পড়েছেন আপনার নাতি নিয়ে।”