দু’মিনিট পরে হাড়ভাঙা হারাধন চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে করুণ গলায় বলতে লাগল, “আমার শখের বাবরি চুল, কোন শয়তান যে ভিড়ের মধ্যে একগোছা উপড়ে নিয়ে গেল। কঁকা ব্রহ্মতালু নিয়ে এখন কোন লজ্জায় লোকালয়ে বেরোই!”
প্রহ্লাদ গম্ভীর হয়ে বলল, “ওরে আর নয়। এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে গেছে। এবার খ্যামা দে বাবারা। লাশটা একটা গর্ত করে পুঁতে ফ্যাল। খুনখারাপি আমার পছন্দ নয়। কিন্তু কী আর করা!”
ঝটাপটি এক সময়ে থামল বটে, কিন্তু অনেক খুঁজেও খাদু গড়াইয়ের লাশটা পাওয়া গেল না।
ওদিকে নীলপুরের জঙ্গলে গভীর রাতে বিজয়গর্বে ফিরে এসেছেন কাশীরাম। মোট পাঁচখানা ডাকাতি করেছেন। স্যাঙাতরা শতমুখে কাশীবাবুর বীরত্বের কথা রাখালহরিকে শোনাচ্ছিল। রাখালহরি তার চেয়ারখানায় জুত করে বসে গোঁফ চোমরাতে চোমরাতে হাসি হাসি মুখ করে শুনছিল। দুলে দুলে বলল, “হবে না! ওসব হল জিনের ব্যাপার। কার রক্ত শরীরে বইছে সেটা দেখতে হবে তো! পরস্পকে নিজস্ব করতে পারাটা একটা জেনেটিক আর্ট। নাঃ, খাঁদুকে যতই দেখছি ততই ভরসা হচ্ছে। আমার ট্র্যাডিশনটা ধরে রাখতে পারবে। যা বাবা খাঁদু, আজ অনেক মেহনত করেছিস, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়।”
পোলাও-মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে নিজের তাবুতে ঢুকে খাটিয়ার বিছানায় কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পেটে শান্তি, মনে প্রশান্তি, চোখে সুষুপ্তি নিয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেন কাশীরাম।।
শেষ রাতে ভারী ভাল একটা স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। একটা বিশাল রাজবাড়িতে ডাকাতি করতে ঢুকেছেন দলবল নিয়ে। সেপাইসান্ত্রিরা তাঁকে দেখেই অস্ত্রশস্ত্র ফেলে সেলাম জানাল। জরির
পোশাক পরা স্বয়ং রাজা এসে তাকে খাতির করে কোথায় ধনরত্ন আছে তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। এমন সময় মন্ত্রীমশাই এসে তার হাতে সসম্মানে একটা টেলিগ্রাম দিল। কাশীবাবু টেলিগ্রাম খুলে দেখলেন, তাতে বাংলায় লেখা, সরকার বাহাদুর এবার আপনাকে ডাকাতরত্ন’ পুরস্কারে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঠিক এই সময়েই কী করে যেন রাজার তলোয়ারের খাপটা তার বুকে একটা খোঁচা দিল। কাশীরাম ককিয়ে উঠলেন, “এ কী!”
চাপা গলায় কে যেন বলল, “আস্তে! সবাই শুনতে পাবে যে!”
কাশীরাম ধড়মড় করে উঠে বললেন, “কে?”
“ওঃ, তোফা আছেন মশাই! ভাল খাট, বিছানা, বিলিতি কম্বল!”
গলাটা চেনা চেনা ঠেকছে। কাশীরাম উবিগ্ন হয়ে অন্ধকারকেই জিজ্ঞেস করলেন, “খাঁদু নাকি হে?”
“ও নামটা তো শুনলুম আপনি দখল করে বসে আছেন! তা আমাকে পাঁচুটাচু কিছু একটা বলে ডাকলেই হবে। খাঁদু নিয়ে বড় টানাটানি হচ্ছে মশাই।”
কাশীবাবু উদবেগের গলায় বললেন, “তুমি এখানে এসে উদয় হয়েছ কেন বলো তো! মতলবটা কী তোমার?”
খাঁদু অতিশয় আহত গলায় বলল, “দেখুন কাশীবাবু, আমার নাম, আমার খুড়ো সবই বেবাক দখল করে বসে আছেন। তার জন্য কি কিছু বলেছি আপনাকে? লোকের ঘটিবাটি চুরি যায়, টাকা-পয়সা চুরি যায়, সে একরকম। কিন্তু নাম চুরি, খুড়ো চুরি কখনও শুনেছেন? আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! এর পর পুকুর চুরি শুনলেও অবাক হব না। কিন্তু সেসব কথা থাক। আমি তো আর ওসব ফেরত চাইছি না মশাই!”
কাশীরাম এই শীতেও কপালের ঘাম মুছে বললেন, “তবে কী চাও? চটপট বলে সরে পড়ো, নইলে আমি লোক ডাকব।”
খাঁদু অতিশয় দুঃখের গলায় বলে, “তা তো ডাকবেনই। মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ বলেও কী যেন একটা কথা আছে। সেটাও কি বিস্মরণ হল আপনার?”
“কীসের কৃতজ্ঞতা? কী বাবদে কৃতজ্ঞতা?”
“এই যে অমন ভাল নামটা দিয়ে দিলুম, অমন শাঁসালো খুড়োকে পর্যন্ত আপনার হাতে সঁপে দিলুম, সে বাবদে কি কৃতজ্ঞতাটুকুও পাওনা হয় না আমার! তার উপর তোক ডাকবেন বলে শাসাচ্ছেন!”
“ওহে বাপু, আজ বড্ড ধকল গেছে। সোজা কাজ তো নয়, এক রাতে পাঁচ-পাঁচখানা ডাকাতি! তা খাটুনির পর মানুষের তো একটু ঘুমও দরকার হয়, নাকি? অত ভ্যাজর ভ্যাজর না করে আসল কথাটা বলে ফেললেই তো হয়।”
“বলছিলাম কী, বাংলায় একটা কথা আছে, খাচ্ছিল তাঁতি তাত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে। কথাটা শোনা আছে কি?”
“খুব আছে। ক্লাস সেভেনে বাক্য রচনায় এসেছিল।”
“সেইটেই বলতে আসা।”
“তা বাপু, এটা এমন কী কথা যে, মাঝরাতে একটা হাক্লান্ত লবেজান লোকের ঘুম ভাঙিয়ে বলতে হবে!”
“আপনি তো মাঝরাতে ঘুম ভাঙানোটা দেখছেন। জানেন কি, এ কথাটা আপনাকে বলার জন্য কত বিপদ ঘাড়ে করে, কত মেহনত করে আসতে হয়েছে? খুড়োমশাইয়ের কল কি সোজা? চারদিকে প্রতিটি গাছে মাচান বেঁধে পাহারার বন্দোবস্ত, হুমদো হুমদো সব সেপাইসান্ত্রি ভয়ংকর চেহারার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চারদিকে পায়চারি করছে। মাছিটিও গলতে পারে না।”
“তাও তো বটে! তা হলে তুমি গলে এলে কী করে?”
“আজ্ঞে, সে নিতান্তই ব্রাহ্মণের আশীর্বাদে।”
“শুধু গলেই আসোনি, এই অন্ধকার জঙ্গলে আমার ভাবুটাও খুঁজে বের করেছ। তার ব্যাখ্যা কী?”
“খুব সোজা। আপনার নাকের ডাক, খেয়াল করলে দেখবেন, সকলের নাক একরকম ডাকে না। কারও বাঘের গর্জন তো কারও শ্যামের বাঁশি, কারও বোমা ফাটার আওয়াজ তো কারও গড়াগড়ার গুড়ুক গুড়ুক শব্দ।”
“তা আমারটা কেমন?”
“তবলা লহরা শুনেছেন তো! অনেকটা সেরকম।” কাশীরাম একটা মস্ত হাই তুলে বলেন, “কথা শেষ হয়েছে তো! তা হলে এবার কেটে পড়ো।”