প্রহ্লাদ রোষকষায়িত লোচনে লোকটাকে একেবারে গেঁথে ফেলে হুংকার দিয়ে উঠল, “অ্যাই, তুই কে?”
লোকটা বিগলিত হয়ে বলে, “আজ্ঞে, কেন বলুন তো? আমি তো খাঁদু গড়াই।”
সভা গর্জন করে উঠল, “মিথ্যে কথা!”
খাঁদু সকলের দিকে মিটমিট করে চেয়ে নিপাট ভালমানুষের মতো বলে, “তা আমার খাঁদু নামটা অনেকের পছন্দ নয় বটে। তা পছন্দ না হলে একটা নাম দিয়ে নিলেই তো হয়।”
চাকু বলল, “তুমি একজন ইমপর্টার।”
গুঁফো গণেশ বিচক্ষণ লোক। বলল, “আহা, ওকে একটু বলতে দাও না হে। বাপু খাঁদু, তুমি কি রাখালহরির আপন ভাইপো?”
“যে আজ্ঞে।”
“তিনি তোমার নিজের খুড়ো তো?”
“আজ্ঞে, আগেরটা হলে, পরেরটা তো হতেই হবে। আমি তার আপন ভাইপো হলে, তিনি পরের খুড়ো হন কী করে?”
“কিন্তু তাই যে হচ্ছে হে খাঁদু? তুমি আপন ভাইপো ভাবলে কী হবে? রাখালডাকাত যে পরের খুড়ো হয়ে বসে আছে!”
খাঁদু পিটপিট করে চারদিকে চেয়ে যেন ভারী ঘাবড়ে গেছে, এমন ভাব করে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল, “কথাটার মধ্যে কি একটা প্যাঁচ আছে নাকি মশাই?”
গণেশ মাথা নেড়ে বলে, “না। আমাদের কথায় প্যাঁচ নেই, কিন্তু বাপু, তোমার কথায় আছে। তাই বলছি, প্যাঁচটা একটু খোলল। রাখালহরির, যত দূর জানি, একটার বেশি দুটো ভাইপো নেই। খবর হচ্ছে, তার হাতে এখন একটা ভাইপো মজুত আছে। তা হলে তুমি হিসেবে আসছ কী করে?”
খাঁদু ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে, “তাই তো মশাই, বড্ড ভাবনায় ফেলে দিলেন!”
“ভাবনার কী আছে হে! আসল কথাটা পকেট থেকে বের করে ঝপাস করে সকলের সামনে ফেলে দাও। তুমি আসলে কে?”
“বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। বিশ্বাস না করারই কথা। তবু যখন চাপাচাপি করছেন, তখন কপাল ঠুকে বলেই ফেলি। আমি আসলে হচ্ছি দয়ালহরি গড়াইয়ের ছেলে ক্ষুদিরাম গড়াই, রাখালহরি গড়াইয়ের ভাইপো। ছেলেবেলায় সবাই ‘খাঁদু, খাঁদু বলে ডাকত, সেই থেকে খাঁদু গড়াই।”
গুঁফো গণেশ মৃদু হেসে বলে, “ওই ঢপের চপ তো আমরা একবার খেয়েছি, আর কেন?”
খাঁদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝতে পারছি মশাই, আমাকে আপনাদের মোটেই মনে ধরছে না। ভাবছেন, বেগুনের বদলে ঝিঙে কিনে এনেছেন। যাচাই করে দ্যাখেননি। তাই যদি হবে তা হলে ছেড়ে দেন না কেন, ফেরত যাই।”
মারকুটে মহেশ লাফিয়ে উঠে বলে, “ছেড়ে দেব মানে? তার আগে ছাল ছাড়িয়ে নেব না!”
খাঁদু কুঁকড়ে গিয়ে বলে, “মারধর করবেন না মশাই। মারধর আমার মোটেই সহ্য হয় না। সেবার গিরীনবাবুর বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা আধুলি পেয়ে ট্যাঁকে খুঁজেছিলুম। ন্যায্য পাওনা মশাই। তা সেই দোষে গিরীনবাবু কাঁকালে এমন গুঁতো মেরেছিলেন যে, তিন মাস আমাশায় ভুগে উঠলুম।”
গুঁফো গনশা মিষ্টি হেসে বলল, “এবার একটু কাজের কথায় এলে হয় না? মারধর করারও তো একটা মেহনত আছে বাপু?”
খাঁদু একগাল হেসে বলল, “যে আজ্ঞে, তা আর নেই! ঝুটমুট মেহনত করবেনই বা কেন?”
“মেহনত আমরা মোটেই করতে চাইছি না। আমরা শুধু জানতে চাই, তুমি আসলে কে? কেনই বা রাখালহরির ভাইপো বলে পরিচয় দিয়ে কী মতলবে এখানে এসেছ? আর ঝুটমুট আমাদের হয়রানটাই বা করলে কেন?”
খুব ভাবিত হয়ে খাঁদু এবার তার মাথা চুলকে নিয়ে বলল, “মুশকিলটা হয়েছে কী জানেন? আমার খুড়ো রাখালহরি চার হাত লম্বা, দশাসই চেহারা। আর আমি রোগাভোগা খেকুরে মানুষ। তাই কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে, আমি তার ভাইপো। আমি তাই ভাবছি, এবার একদিন কাছারিতে গিয়ে এফিডেবিট করে নামটাই পালটে ফেলব। ভাইপো হয়ে কোনও সুখ নেই মশাই। খুড়ো হলেও
হয় হত। কথায় আছে ‘নাল্পে সুখমস্তি, খুড়ৈব সুখম্।’”
গণেশ বলল, “কথা ঘোরাচ্ছ হে। অন্যের কথা ছেড়ে দাও, তোমার খুড়োই তো তোমাকে ভাইপো বলে মানতে চাইছে না। মাত্র দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিলাম, রাখালডাকাত একটা পয়সাও উপুড় হস্ত করতে রাজি নয়। তার চেয়েও বড় দুঃসংবাদ, তার আসল ভাইপো খাঁদু গড়াই এখন রাখালহরির ডান হাত হয়ে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছে।”
খাঁদু চোখ বড় বড় করে ভারী অবাক হয়ে বলল, “বলেন কী মশাই, মাত্র দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছেন! খুড়োমশাইয়ের যে কোটি কোটি টাকা! ওই জন্যেই তো তার বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছেন, এত কম যখন চাইছে তখন নিশ্চয়ই সে আমার আসল ভাইপো নয়। হায়, বড় ভুল করে ফেলেছেন মশাই!”
মহেশ রুখে উঠে বলল, “হ্যাঁ, বড্ড ভুল হয়েছে হে। তবে এবার আর ভুল করছি না। গণেশদাদা, তুমি সরো তো! ভাল কথায় কাজ হওয়ার নয়, অন্য ওষুধ দরকার।”
একথায় সভাস্থলে অন্যরাও ‘রে-রে করে উঠল। প্রহ্লাদ আর গণেশ চেষ্টা করেও আটকাতে পারল না। কুড়ি-পঁচিশজন তাগড়াই ডাকাত হাউড়ে এসে পড়ল খাঁদু গড়াইয়ের উপর। প্রবল ঝটাপটির মধ্যে কিল-চড়-লাথি পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। চারদিকে তুমুল চেঁচামেচি আর গন্ডগোল।
যা কাণ্ড ঘটছিল তাতে খাঁদুর বেঁচে থাকার কথাই নয়। ঝটাপটির ভিতর থেকে প্রথমে টলতে টলতে বেরিয়ে এল মল্লিক, তার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। প্রহ্লাদের দিকে চেয়ে কঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “টেকো টগরের কাণ্ডটা দেখলেন! এমন ঘুসো মেরেছে যে, নির্ঘাত নাকের হাড় ভেঙেছে! একটু পরেই ক্যাকাতে ক্যাকাতে লেঠেল ললিত বেরিয়ে মাজা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে বলল, “কোন বদমাশ যে গোদা পায়ের লাথিটা ঝাড়ল, মাজাটা গেছে।”