কাশীবাবু বুক চিতিয়ে মন্দ্র স্বরে আবৃত্তি করতে লাগলেন, “ক্ষুদিরাম মোর নাম, নিবাস নীলপুর ধাম, খুল্লতাত রাখাল গড়াই, গহীন জঙ্গলে বসে, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস, সকলের সর্বস্ব সরাই।”
নগেন মহিষ গদগদ হয়ে বলেন, “ওরে চুরি-ডাকাতি করতে গেলে যে নাম ভাঁড়াতে হয়, তা কি আমি জানি না? যে নামই নিস
কেন বাবা, তুই যে আমাদের আদরের সেই ছোট্ট কাশী তা কি ভুলতে পারি? তুই নসিবাবুর ছেলে, শশীরামের নাতি!”
কাশীবাবু নাটুকে ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, “ওরে, বাপ-দাদা নাই, নাই বৃথা বসে ক্রন্দন, ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজ-রচনা। আছে শুধু কাকা, যেন অমিতাভ বচ্চন, ঊষা-দিশাহারা-নিবিড় তিমির আঁকা। ওরে ক্ষুদিরাম, ওরে ক্ষুদিরাম মোর। এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা।”
.
ঠিক এই সময় মাইল আষ্টেক দুরে মহিষবাথানের জঙ্গলে মশালের আলোয় একটা মস্ত শিশুগাছের তলায় একটা মিটিং বসেছে। চেয়ারম্যান প্রহ্লাদের হাতে একখানা খোলা চিঠি, তার জ্ব কোঁচকানো, মুখ গম্ভীর। সে বলল, “ভাইসব, চিঠির বয়ান পড়ে মনে হচ্ছে রাখালহরি তার ভাইপোর জন্য মুক্তিপণ দিতে রাজি নয়।”
সড়কি সতীশ বলল, “তখনই তো বলেছিলাম দাদা, ওরকম মর্কটের মতো চেহারার একটা হাড়গিলের জন্য দরটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। দরটা কম করে দিলে খেয়ে যেত।”
লেঠেল ললিত বলল, “আহা, দর তো বেশি দেওয়ারই দস্তুর। পার্টি কষাকষি করলে দর নামানো যেত। কিন্তু এ তো মোটেই দরাদরিই করল না। ফস করে লিখে পাঠাল যে, এক পয়সাও দেব না, যা খুশি কর। খুড়ো হয়ে ভাইপোর উপর এতটা নৃশংস হওয়া কি রাখালহরির ঠিক হল? নাঃ, দিনকাল যা পড়েছে, সম্পর্কের আর দামই নেই।”
গুঁফো গণেশ ভারী হতাশার গলায় বলে, “নাঃ, এত মেহনত জলেই গেল। কেত্তনের দল নিয়ে গিয়ে কত কায়দা করে পাঁকাল মাছ ধরার মতো করে ধরে নিয়ে এলাম, বসিয়ে বসিয়ে কয়েক দিন ভালমন্দ খাওয়ালাম, তার একটা দাম নেই?”।
মারকুটে মহেশ বলল, “কিন্তু পাক্কা খবর ছিল রাখালডাকাত তার লাখো লাখো টাকা আর কয়েক মন সোনা, সেই সঙ্গে দল চালানোর ভার দেওয়ার জন্য হন্যে হয়ে তার ভাইপোকে খুঁজছে। তা আমরা তো সেই ভাইপোকেই খুঁজে দিচ্ছি। ভাইপোর চেয়ে কি টাকাটা বেশি হল? ওরে বাপু, ক’দিন পরে ওই খাঁদুই তো রাখালডাকাতের টাকার পাহাড়ের উপর গ্যাঁট হয়ে বসে হাওয়া খাবে।”
“না, খাবে না।” বলে চাকু চপল উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের ইনফর্মেশন নেটওয়ার্ক খুব খারাপ। আমি অনেক দিন ধরেই বলছি, আধুনিক টেকনোলজি আর সফিস্টিকেটেড নেটওয়ার্ক ছাড়া এ যুগে আমাদের কাজকর্ম চালানো সম্ভব নয়। মান্ধাতার আমলের ইনফ্রাস্ট্রাকচার কি এই ইলেকট্রনিকের যুগে চলে?”
প্রহ্লাদ বলল, “আহা, তোমার মোদ্দা কথাটাই ভেঙে বলো না বাপু! নেটওয়ার্কের ডেভেলপমেন্ট করতে তো সময় লাগবে। রাতারাতি তো হবে না। বলি ব্যাপারটা কী?”
চাকু চপল অত্যন্ত ব্যথিত গলায় বলল, “আপনারা একটা ভুল লোককে খাঁদু গড়াই ভেবে ধরে এনেছেন। ও খাঁদু ওরফে ক্ষুদিরাম গড়াই নয়। আসল খাঁদু গড়াই অলরেডি রাখালহরির ছত্রছায়ায় তৈরি হতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হল, ট্রেনিং পিরিয়ডে ক্ষুদিরাম গড়াই যে এলেম দেখিয়েছে, তাতে রাখালহরির ধারণা হয়েছে, খাঁদু তাকেও ছাড়িয়ে যাবে।।
সভায় প্রবল গুঞ্জন শুরু হল। সবাই খাড়া হয়ে বসল, কয়েকজন গলা তুলে বলল, “ভেঙে বলো হে! আমরা ডিটেলস শুনতে চাই।”
প্রহ্লাদও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, “বলো কী হে? এরকম ভুল হওয়ার তো কথা নয়! এ-খবর তোমাকে কে দিল হে?”
“আজ্ঞে ঘোড়ার মুখের খবর। আমার মেসোমশাইয়ের মাসতুতো ভাই হল গাব্ব। সে এই বছরখানেক হল জুনিয়র অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে রাখালহরির দলে ঢুকেছে রীতিমতো কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে। হালে সিনিয়র অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে অ্যাকশনে নেমেছে। মাধবপুরের হাটে গত কালই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। চেহারার চেনাই দেখলে হিংসে হয়। ফেডেড জিন্স, ইতালিয়ান টি শার্ট, হাতে দু-দুটো হাইফাই মোবাইল, চোখে গুচ্চি গল। চেহারা একেবারে ছমছম করছে। কথায় কথায় বলল, ওদের নতুন লিডার এসে গেছে এবং সে নাকি পুরো সুপারম্যান। প্রথমটায় ভাঙছিল না, পরে স্বীকার করল, লিডার হল রাখালহরির ভাইপো ক্ষুদিরাম গড়াই।”
গুঁফো গণেশ ডুকরে উঠল, “বলিস কী! তা হলে এ কে? এ কি খাঁদু গড়াই নয়?”
চাকু গম্ভীর মুখে বলল, “দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, না, এ খাদু গড়াই নয়। এ জালি মাল।”
সভায় তুমুল শোরগোল উঠল।
প্রহ্লাদ হাঁক দিয়ে বলল, “চুপ, চুপ! সাইলেন্স! খবরটার সত্যতা বিচার না করেই উত্তেজিত হওয়া বিচক্ষণের লক্ষণ নয়। ধরেই নিচ্ছি, চাকু ঠিক কথাই বলেছে, এ-বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি তৈরি হোক। তদন্তের রিপোর্ট দেখে…”
ছিনতাই ছানু কম কথার লোক। এতক্ষণ কথা বলেওনি। এবার সে ব্যাপারের ভিতর থেকে মুন্ডু বের করে বলল, “প্রহ্লাদভায়াকে আর তদন্ত কমিটি করতে হবে না। বরং যাকে ধরে এনেছ তার পেটে গুঁতো দিয়ে কথা বের করে নাও। খামোখা সময় নষ্ট।”
সকলে হর্ষধ্বনি সহযোগে সমর্থন জানাল।
প্রহ্লাদের হুকুমে আটজন সশস্ত্র ডাকাত খাঁদুকে একেবারে ঘিরে ধরে নিয়ে এল প্রহ্লাদের সামনে। এত ভয়ংকর ডাকাতের মাঝখানে থেকেও লোকটার এতটুকু হেলদোল নেই। বেশ নিশ্চিন্ত মনে আছে।