“তা হলে তো মুশকিল হল হে। তা তোমার খুড়োমশাই কি বেশ পয়সাওলা লোক?”
খাঁদু চোখ বড় বড় করে বলে, “তা তো বটেই। কুঠিবাড়ি লুট করে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন যে! তারপর ডাকাত হিসেবে তাঁর আরও নামডাক হয়।”
“ডাকাত!” বলে কাশীবাবু হাঁ করে চেয়ে রইলেন।
“যে আজ্ঞে। তেমন চুনোপুটি ডাকাতও নন। তাঁর মাথার দাম এখন লাখ টাকা।”
“ওরে বাবা! শুনেই যে আমার হৃৎকম্প হচ্ছে! তুমি তো সাংঘাতিক লোক হে। ডাকাতের ভাইপো!”
“আজ্ঞে, ওইটেই তো হয়েছে মুশকিল! ডাকাতের ভাইপো শুনে লোকে বড় ঘাবড়ে যায়। অনেকে সন্দেহ করে, ভয় পায়, ঘটিবাটি সামলে রাখে। অনেকে আবার পুলিশে খবর দেওয়ার উদ্যোগ করে। কী ফ্যাসাদ বলুন দিকি! আমি মশাই, নিতান্তই নিরীহ ধর্মভীরু লোক। খুড়োমশাই হাতে মাথা কাটেন বটে, কিন্তু আমার তো মশা মাছি মারতেও হাত সরে না!”
কাশীবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তা হলে বাপু, তুমি বরং অন্য কারও ভাইপো হলেই ভাল করতে। এই ধরো উকিল-মোক্তার বা ডাক্তার। ডাকাতের ভাইপো হওয়াটা মোটেই ভাল কথা নয়।”
“আজ্ঞে, সে কথাও খুব ভাবি। আমার যা স্বভাব, তাতে ওরকম একজন ডাকসাইটে ডাকাতের ভাইপো হওয়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। তিনি লাখো লাখো টাকা লুটছেন বটে, কিন্তু আমি মরছি বিবেক দংশনের জ্বালায়। এই তো দেখুন না, দিনদুই আগে নারানপুর গাঁয়ের হাটখোলায় একছড়া সোনার হার কুড়িয়ে পেলুম। তা ভরিটাক ওজন তো হবেই। কিন্তু যেই হাতে নিয়েছি অমনই যেন বিছুটি পাতার জ্বালা। সে কী জ্বলুনি মশাই, কী বলব! তারপর সারা গাঁ তোলপাড় করে যার হার হারিয়েছিল সেই খুকিটিকে খুঁজে বের করে তার হাতে হারছড়া তুলে দিয়ে তবে নিষ্কৃতি।”
“তা হলে তো বাপু, তুমি বেশ দোটানার মধ্যেই পড়েছ। একদিকে ডাকাতখুড়ো, অন্যদিকে বিবেকবুড়ো?”
“যথার্থই বলেছেন মশাই। দু’দিকের টানাহ্যাঁচড়ায় বড্ড জেরবার হচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কী, বিবেক দংশন যেমন আছে তেমনই খিদের জ্বালাও তো আছে। বাইরে থেকে দেখলে ঠিক বুঝবেন না, আমার ভিতরে বিবেক আর খিদের কেমন সাংঘাতিক লড়াই চলছে। ওফ, সে যেন সুন্দ-উপসুন্দের যুদ্ধ। কখনও বিবেককে ধরে খিদে এমন আছাড় মারে যে, বিবেকের অক্কা পাওয়ার দশা। কখনও আবার বিবেক তেড়েফুঁড়ে উঠে খিদেকে এমন চেপে ধরে যে, খিদের তখন দম আটকে মরার অবস্থা। তা এই খিদে যখন মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে ওঠে, তখন কখনও-সখনও চুরি-ডাকাতি করতে যে ইচ্ছে যায় না তা নয়। তখন যেন খুড়োমশাই আমার ঘাড়ে ভর করেন। এই তো গেল হপ্তায় গোলোকগঞ্জে দিনদুই উপপাসের পর দুর্বল শরীরে একটু ঘোরাঘুরি করছি, হঠাৎ দেখি, একটা বাড়ির বাগানের বেড়ার ধারে একটা পেঁপে গাছে একেবারে হাতের নাগালে
একখানা হলুদ বরণ পাকা পেঁপে ঝুলে আছে। যেই না দেখা, অমনিই আমার খিদে লাফিয়ে উঠে বিবেককে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে পাঁইপাঁই করে ছুটল।”
কাশীবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, “বটে! তারপর কী হল!”
“আজ্ঞে, খিদে প্রায় জিতেই গিয়েছিল আর কী! আর-একটু হলেই মহাপাপটা করেই ফেলছিলুম প্রায়। কিন্তু হাত বাড়িয়ে পেঁপেটা যখন সাপটে ধরেছি, তখনই ভিতর থেকে বাঘের মতো বিবেক গর্জন করে উঠল, “খবরদার, খাঁদু! এখনও পৃথিবীতে চন্দ্র সূর্য উঠছে, এখনও গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা খেলছে, এখনও গোরুর দুধে সর পড়ে, এখনও দধিমন্থন করলে মাখন ওঠে, এখনও পাটালি গুড় দিয়ে পায়েস হয়। তাই বলছি, এ-পাপ তোর ধর্মে সইবে না। বুঝলেন মশাই, কী বলব, বিবেকের সেই বাঘা গর্জনে শরীরে যেন ভূমিকম্প হতে লাগল। মনস্তাপে মনটা ভরে গেল। হাত সরিয়ে নিলুম, পেঁপেটা যেমন ঝুলছিল তেমনই ঝুলে রইল।”
কাশীবাবু একটা খাস ছেড়ে বললেন, “যাক বাবা! পেঁপেটার জন্য ভারী দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার।”
“যে আজ্ঞে, হওয়ারই কথা। তবে পেঁপে বাঁচলেও এই খাঁদু গড়াইয়ের যে মরার দশা হয়েছিল মশাই! বিবেকের মার খেয়ে খিদে হার মানল বটে, কিন্তু আমার পেটে এমন কুঁইকুই করে ঘুরে বেড়াতে লাগল, কিছুতেই বাগ মানে না। ধর্ম রাখতে গিয়ে প্রাণ যায় আর কী? আচ্ছা মশাই, এটা কলিযুগ বলেই কি ধর্মভীরু মানুষরাই শুধু কষ্ট পায়, আর পাপীতাপী, খুনে-গুন্ডারা দিব্যি হেসে-খেলে বেড়ায়?”
“তা বাপু, কথাটা মন্দ বলেনি। আমিও শুনেছি, কলিযুগে সব উলটো নিয়ম।”
“আজ্ঞে, তাই হবে। আচ্ছা মশাই, আপনি কি ‘সধবার দীর্ঘশ্বাস বা ডাকাতের দয়া’ যাত্রাপালা দেখেছেন?”
“না বাপু, যাত্রাটাত্ৰা আমি বড় একটা দেখি না।”
পিছন থেকে নরহরি বলে, “আমি দেখেছি, বড্ড ভাল পালা, চোখের জল রাখা যায় না।”
খাঁদু একগাল হেসে বলল, “তবেই বুঝুন, এ কলিযুগ না হয়ে যায় না।”
কাশীবাবু অবাক হয়ে বলেন, “কেন বাপু, যাত্রাপালার সঙ্গে কলিযুগের সম্পর্ক কী?”
“বুঝলেন না! ও দুটো পালাই আমার খুড়োমশাইকে নিয়ে লেখা। আর শুধু কি পালা? তাঁকে নিয়ে কত গান বাঁধা হয়েছে জানেন? শোনেননি? সেই যে, মিছেই করো দৌড়াদৌড়ি, হাতে নিয়ে দড়াদড়ি, পরাবে যে হাতকড়ি হে কোথায় পাবে হাত, বাপের ব্যাটা রাখালহরি, তারই দয়ায় বাঁচি মরি, তার হাঁকেডাকে দাপে খাপে সবাই কুপোকাত…হবে সবাই কুপোকাত। শোনেননি?”
“না হে বাপু।”