কমলেকামিনী দেবী ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে আমার কাশী, ডাকাত হয়েছিস বলে কি সম্পর্ক উলটে দিলি দাদা? কোন আকেলে নিজের ঠাকুরমাকে ‘দিদিমা বলে ডাকছিস রে মুখপোড়া? কোন সুবাদে আমি দিদিমা হতে গেলুম বল তো হনুমান! এইটুকু বয়স থেকে বুকে করে মানুষ করলুম, মরার আগে তোর মুখে দিদিমা ডাক শুনব বলে? বালাজোড়া চাস, এই নে, খুলে দিচ্ছি, তোর বউকে এই বালা দিয়ে আশীর্বাদ করব বলেই রেখেছিলুম যা, নিয়ে যা। পুলিশের গুঁতো খেয়ে মাথাটাই তোর খারাপ হল কিনা কে জানে!”
কাশীবাবু হতাশায় মাথা নেড়ে আপনমনে বললেন, “ওফ, বুড়োবুড়িদের সঙ্গে আর পারা যায় না।”
রান্নাঘরে হানা দিয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে কাশীবাবু বললেন, “এই যে মাসিমা, গলার হারছড়া খুলে দিন আর গয়নাগাটি কোথায় আছে চটপট বের করুন। আমাদের সময় নেই।”
নবদুর্গা হাঁ করে চেয়ে বললেন, “ও বাবা কাশী, মুখে কালি মেখে কি মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় বাবা আমার! ভাবছিস মাসি ডেকে চোখে ধুলো দিবি। তাই কি হয় রে বাবা! ডাকাতি করছিস না হয় কর। কিন্তু অত খাটুনি কি তোর সইবে বাবা! শুকিয়ে যে আধখানা হয়ে গেছিস। পিড়ি পেতে বোস তো বাপ, গরম গরম দুটো ভাত খা। তেলকই আছে, পোস্তর বড়া, ধোঁকার ডালনা আর শেষ পাতে পায়েস। গয়নাগাঁটি যা চাস বের করে দিচ্ছি বাবা, শুধু মাথার দিব্যি, দুটি খেয়ে যা!”
কাশীরাম সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, “লৌকিকতার কোনও দরকার নেই। এখন আমাদের কাজের সময়। তাড়াতাড়ি করুন।”
নবদুর্গা তাড়াতাড়ি হার খুলে দিলেন। আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে হাতে দিয়ে বললেন, “আলমারির কোথায় কী আছে সবই তো জানিস বাবা, বের করে নিগে যা। ওরে শোন, ছেলেবেলায় আমাদের গাঁয়ের কালুডাকাতকে দেখেছি, রোজ দু’সের করে মাংস, পাঁচ পো দুধ আর আধসের করে ভেজানো ছোলা খেত।”
বাজে কথা শোনার সময় নেই কাশীরামের। তিনি চটপট শোওয়ার ঘরে গিয়ে গয়নার বাক্স বের করে নিলেন।
আধঘণ্টার মধ্যেই ডাকাতি শেষ করে সবাই মিলে গিয়ে জিপে উঠে রওনা হয়ে গেলেন।
শশীরাম আহ্লাদে গদগদ হয়ে বললেন, “দেখলি নসে?”
নসিবাবুর মুখও উজ্জ্বল, বললেন, “দেখলুম বই কী?” মাতব্বররাও সব আড়াল-আবডাল থেকে বেরিয়ে এলেন।
উপেনবাবু বললেন, “নসিবাবু, ক্ষমা করবেন। আপনার কথা প্রথমটায় বিশ্বাস করিনি। আমাদের নড়েভোলা কাশী যে জীবনে এত উন্নতি করবে সেটা তো কল্পনাও করিনি মশাই।”
যোগেনবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “নসিবাবু, একটু দেখবেন। কাশীরামের যা দাপট দেখলাম, আমরা গরিবরা না বেঘোরে পড়ি!”
বিরিঞ্চি পোদ্দার গম্ভীর মুখে বললেন, “না না, এটা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। শত হলেও কাশীরাম যে সমাজবিরোধী হয়ে গেল, এটা মোটেই ভাল হল না।”
খগেন পাল খিচিয়ে উঠে বলে, “রাখুন তো মশাই সমাজবিরোধী! সমাজবিরোধী না হলে এ-যুগে তালেবর হওয়া যায় নাকি? একটা তালেবর লোক খুঁজে বের করুন তো, যে সমাজবিরোধী নয়। এই যে কানাইদারোগা থানায় বসে বসেই রোজ কাঁড়ি কাঁড়ি ঘুষ খাচ্ছে, সে সমাজবিরোধী নয়? নগদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, মুরগি, মাছ, পাঁঠা, হাঁড়ি-ভরতি রসগোেল্লা, বউয়ের জন্য শাড়ি, কী না নিচ্ছে বলুন?”
ফের একটা তর্ক বেধে উঠল এবং সবাই উত্তেজিতভাবে আলোচনায় বসে গেলেন।
ওদিকে নগেন মহিষের বাড়িটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় কাশীবাবুর মাথায় চিড়িক করে একটা পুরনো ঘটনা খেলে গেল। অনেক দিন আগে গাঁয়ে বাগদিবাড়ির বউ’ বলে একটা যাত্রাপালা হয়েছিল। কাশীবাবু তখন খুব ছোট, পালিয়ে গিয়ে চুপিচুপি যাত্রার আসরের তাঁবুর ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন। নগেন মহিষ তাঁকে ধরে ফেলে এবং টিকিটবাবুদের হাতে তুলে দেয়। টিকিটবাবু আচ্ছাসে কান মলে বের করে দিয়েছিল তাঁকে।
মনে পড়তেই ‘রোখকে, রোখকে’ বলে জিপ থামিয়ে লাফ দিয়ে নামলেন কাশীবাবু, তারপর সেই ‘রে-রে-রে’ গর্জন। চারদিকে ফের বায়ুকম্প, কুকুরেরা কেঁউ কেঁউ, কাকেরা কা কা করতে থাকল, বাড়ির ভিতর নগেন মহিষের মহিষী মূৰ্ছা গেলেন এবং নগেন মহিষ ডাল মাখা ভাতের গরাস মুখে দিতে গিয়ে নিজের ডান কানে খুঁজে দিলেন।
পদাঘাতে দরজা ভেঙে বীরদর্পে ঘরে ঢুকলেন কাশীরাম। একটা অট্টহাসি হেসে বললেন, “এই যে নগেনবাবু, এবার?”
নগেন মহিষ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “প্রাণে মেরো না বাবা, যা আছে নিয়ে যাও।”
স্যাঙাতরা যথাসাধ্য লুটপাট চালাতে লাগল বটে, কিন্তু হাবু বলল, “ওস্তাদ, ভুল বাড়িতে ঢোকেননি তো! এ লোকটা নিতান্তই ছিচকে দেখছি। দামি জিনিসটিনিস নেই!”
কাশীরাম হুকুম দিলেন, “যা আছে তাই নাও। একে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।”
হঠাৎ নগেন মহিষও কাশীরামকে চিনতে পারলেন। একগাল হেসে বলে উঠলেন, “ওরে, তুই আমাদের কাশী না? হ্যাঁ কাশীই তো। ওরে তোকে যে কত কোলেপিঠে করেছি, সব ভুলে গেলি!”
কাশীবাবু পেল্লায় এক ধমক মারলেন, “চোপ! গোলমাল করলে খুলি উড়িয়ে দেব।”
“তা তো দিবি বাবা, কিন্তু পুরনো কথা কি সব ভুলে গেলি? সেই যে গুটিগুটি পায়ে এসে বাটি ভরে সত্যনারায়ণের সিন্নি খেয়ে যেতিস, মনে নেই। আর সেই যে সেবার, তোর গ্যাসবেলুনটা হাত ফসকে উড়ে গিয়েছিল বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছিলি, দেখে আমি তোকে হরগোবিন্দর দোকান থেকে পঞ্চাশ পয়সার লজেঞ্জুস কিনে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে?”