ঠিক এই সময়ে কাশীরাম জিপ থেকে লাফ দিয়ে নামলেন। সঙ্গে আরও দশ-বারোজন বিশালদেহী ডাকাত, সকলেরই মুখে ভুসোকালি মাখা। চেনার জো নেই। কাশীরামের কোমরের দু’দিকে দুটো খাপে-ভরা পিস্তল, হাতে এ কে ফর্টি সেভেন। নেমেই তিনি “রে-রে-রে-রে-রে…,” বলে একটা গর্জন ছাড়লেন। গত পনেরো দিন যাবৎ এই গর্জনটা তাঁকে অনেক সাধনা করে শিখতে হয়েছে। ঠিক গর্জন নয়, একে বলে নাদ। নাভিমূল কাঁপিয়ে সেখান থেকে নাদটিকে পেটের ভিতর দিয়ে বুকে তুলে তবে গলা দিয়ে ছাড়তে হয়। এর শব্দে চারদিকে একটা বায়ুকম্প ওঠে। তাতে গাছের শুকনো পাতা সব খসে পড়ে, নেড়ি কুকুরেরা লেজ গুটিয়ে কুঁইকুই করে পালায়, গেরস্তদের দাঁতকপাটি লাগে।
নিতান্তই এটা বীরের বাড়ি বলে কারও দাঁতকপাটি লাগল না বটে, কিন্তু স্তম্ভন হল। যেমন কলা সাপটানো দুধ আর খইয়ের মণ্ডটা মুখে চালান করতে গিয়ে শশীরাম ওই অবস্থাতেই ফ্রিজ হয়ে গেলেন, নসিরাম কানাইদারোগার নিন্দে করতে গিয়ে সবে “কা” উচ্চারণ করেছেন, ওই হাঁ আর বন্ধ হল না। রাঁধুনি কই মাছ তেলে ছাড়তে গিয়ে সেই যে কাঠ হয়ে গেল, আর তেলের সঙ্গে মাছের দেখাই হল না। কমলেকামিনী দেবীর মালা টপকানোর আঙুল এমন জট পাকিয়ে গেল যে, মালা তার ঘূর্ণনবেগ হারিয়ে নেতিয়ে ঝুলে রইল, নবদুর্গা বসা অবস্থা থেকে উঠতে গিয়ে অর্ধেক উঠে সেই যে থেমে গেলেন, আর ওঠাও হল না, বসাও হল না। নরহরি রামায়ণের একটা সর্গ শেষ করে ভারী রামায়ণখানা তুলে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করছিল, সেই প্রণাম আর শেষ হচ্ছিল না। বারান্দায় বসা গাঁয়ের মাতব্বরদের কয়েকজনের মুছার মতো হয়েছিল, আর কয়েকজন বায়ুকম্পে কেতরে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন। কাশীবাবু বীরদর্পে বাড়িতে ঢুকে চারদিকের দৃশ্য দেখে ভারী খুশি হলেন। হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হেসে স্যাঙাতদের বললেন, “এইবার লুটপাট শুরু হোক।”
তাঁর স্যাঙাতরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে তাঁকে দেখছিল। তারাও হাঁকার দিয়ে থাকে বটে, কিন্তু তাতে এরকম কাজ হয় না। এ লোকটা এক হাঁকারেই বাড়িসুদ্ধ লোককে স্ট্যাচু বানিয়ে দেওয়ায় তারা ভারী অবাক। “যে আজ্ঞে,” বলে তারা কাজ শুরু করে দিল। একমাত্র রাখালহরিই এরকম হাঁকার দিতে পারে।।
শশীরাম শক্ত ধাতের মানুষ। স্তম্ভনটা চট করে কাটিয়ে উঠে তিনি পিটপিট করে চেয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “ও নসে, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি?”
নসিরামও সামলে উঠেছেন। বললেন, “হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে! অ্যাই তোরা কারা? ডাকাত নাকি? সিংহের গুহায় ঢুকেছিস ব্যাটারা, সে খেয়াল আছে? ও গিন্নি হাত-দাখানা দাও তো, দেখাচ্ছি মজা।”
শশীরাম তাড়াতাড়ি দুধ-খইয়ের হাত ধুতির খুঁটে মুছে নিয়ে আলমারি খুলতে খুলতে চেঁচাতে লাগলেন, “কই, আমার বন্দুকটা! ব্যাটাদের আজ মুন্ডু উড়িয়ে দেব।”
ফের অট্টহাসি হেসে কাশীরাম বললেন, “নসিবাবু, নারকেলের ছোবড়া কেটে কেটে আপনার হাত-দা কবেই ভোঁতা হয়ে গেছে। আর শশীবাবু, আপনার একনলা বন্দুকে যে মরচে ধরেছে, সে খবর কি আমাদের জানা নেই ভেবেছেন?”
শশীরাম হঠাৎ থতমত খেয়ে বললেন, “ওরে ও নসে, এই ডাকাতের গলাটা যে অবিকল আমার কেশোর মতো!”
নসিবাবুও একটু ঘাবড়ে গেছেন। আমতা আমতা করে বললেন, “হ্যাঁ, গলাটা সেরকমই তো মনে হচ্ছে।”
কাশীরাম পূর্ব অপমানের কথা সামলাতে না পেরে হঠাৎ অত্যন্ত দুঃখের গলায় গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন, “কারও কেউ নই গো আমি, কেউ আমার নয়, কোনও নাম নেই কো আমার শোনো মহাশয়…”।
শশীরাম গান শুনতে শুনতে তালে তালে মাথা নেড়ে ফের চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে নসে, এ যে আমাদের কাশীই রে! ভুল হওয়ার জো নেই।”
নসিরাম মাথা চুলকে বললেন, “তাই তো? এ তো কাশীই মনে হচ্ছে বাবা!”
“ওরে, আমি তখনই জানতাম, আমার কেশোর মতো ডাকাবুকো ছেলেকে আটকে রাখার মতো জেলখানা এখনও এদেশে তৈরি হয়নি। ওরে, কাশী জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছে! দ্যাখ, দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ, কেমন তেজি চেহারা! কেমন টগবগ করছে এনার্জিতে! ওর পুরুষকার জেগে উঠেছে! ও গিন্নি, উলুটুলু দাও! শাঁখটাখ বাজাও ! পাঁচজনে এসে দেখুক…”
কাশীরাম পেল্লায় এক ধমক দিয়ে বললেন, “চোপ! একদম চেঁচামেচি নয়! কাজে কোনওরকম বাধা দিলেই গুলি ছুটবে কিন্তু! নিন, আলমারিটা খুলে ফেলুন, টাকাপয়সা যা আছে বের করে দিন।”
শশীরাম অতি আলগোছের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “বটেই তো! বটেই তো! কাজের সময় বাজে কথা বলতে নেই। তা এই নে বাপু চাবি, সব চেঁছেপুঁছে নিয়ে যা দেখে আমি দু’চোখ সার্থক করি। ওঃ, এত দিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন! আহা, লুটেপুটে নে তো ভাই, আমি দু’চোখ ভরে দেখি!”
কাশীবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “বুড়োদের এই এক বদ স্বভাব। কেবল বকবক করবে। ওরে, তোরা ওঘরে গিয়ে নসিবাবুর বিছানার তোশকটা তুলে দ্যাখ তো!”
নসিবাবু ভারী আপ্যায়িত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ বাবারা, ভাল করে দ্যাখো, আমার তোশকের তলায় বেশ কয়েক হাজার টাকা আছে বটে। এই আনন্দের দিনে কিছু ফেলে যেয়ো না। গুনেগেঁথে নাও গে যাও।”
কাশীবাবু সদর্পে কমলেকামিনী দেবীর ঘরে ঢুকে বললেন, “এই যে দিদিমা, হাতের বালা দুটো চটপট খুলে দিন তো! একদম সময় নষ্ট করবেন না।”