“সর্বনাশ! সর্বনাশ!” বলতে বলতে নসিবাবু তাড়াতাড়ি থানা থেকে বেরিয়ে ছুটতে লাগলেন।
আর ঠিক এই সময় নীলপুরের ভয়াল জঙ্গলের একেবারে ভিতরে একটা ভারী নিরিবিলি জায়গায় কাশীবাবু বিশ ফুট উঁচুতে শূন্যে একটা দড়িতে ঝুল খেয়ে এক গাছ থেকে আর-একটা গাছে যাচ্ছেন। বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই তিনি দড়ি ধরে ঝুলছেন, তেমন কোনও বিকার নেই তাঁর মুখে। বরং একটু যেন হাসি হাসি ভাবই লেগে আছে। এর আগে ভোরবেলা উঠে চাটি ভেজানো ছোলা আর আদা খেয়ে মাইল চারেক দৌড়োত হয়েছে তাঁকে। তারপর দুশো ডন আর দুশো বৈঠক, মুগুর ভাঁজা, যুযুৎসু অনুশীলন এবং কুস্তি করতে হয়েছে তাঁকে। নির্বিকারভাবেই করে গেছেন। প্রথম কয়েক দিন হাঁফ ধরে যেত, গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হত। আজকাল আর ওসব হয় না।।
দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে এক গাছ থেকে একশো ফুট দূরের আর এক গাছে গিয়ে উঠতে তাঁর বেশ মজাই লাগছে। বিশ ফুট নীচে উর্ধ্বমুখে দাঁড়িয়ে তাঁর এই কসরত খুব মন দিয়ে দেখছে রাখালহরি আর তার প্রায় পঞ্চাশজন স্যাঙাত। প্রত্যেকের মুখেই বেশ শ্রদ্ধার ভাব। রাখালের মুখে একটু তৃপ্তির হাসি। স্যাঙাতদের দিকে চেয়ে বলল “ওরে, ওকে আমি ঠিকই চিনেছিলুম। গায়ে আমার রক্তটা তো আছে। যা এলেম দেখাচ্ছে তাতে একদিন আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। কী বলিস তোরা ?”
সবাই একমত হয়ে হর্ষধ্বনি করল। কাশীবাবু একশো ফুট পার হয়ে গাছের ডালে উঠে পড়লেন। তারপর সাবলীল ভঙ্গিতে নেমে মাটিতে পা রাখতেই রাখালহরি এসে তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “শাবাশ, এই তো চাই। মাত্র কুড়ি দিনে তোর যা উন্নতি দেখলাম, অন্যদের এক বছরে হয় না।”
এই সাধুবাদে কাশীবাবুর অবশ্য কোনও ভাবান্তর হল না। আজকাল তিনি খুবই নির্বিকার হয়ে গেছেন। যা বলা হচ্ছে যন্ত্রের মতো তাই করে যাচ্ছেন। রাখালহরি এবার ভারী আদুরে গলায় বলল, “বাবা খাঁদু, এবার যে তোর হাতে-কলমে পরীক্ষা। আজ রাতেই তোর ডাকাতির হাতেখড়ি। আমি ঠাকুরমশাইকে দিয়ে পাঁজি দেখিয়ে রেখেছি। সন্ধের পর একটা জোর মাহেন্দ্রক্ষণ আছে।”
কাশীবাবু বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, “যে আজ্ঞে।”
“প্রথম কাজটা সোজাই দিচ্ছি। বিপদের তেমন ভয় নেই। খুনখারাপি বা মারকাট আমি কোনওদিনই পছন্দ করি না। ডাকে হাঁকে-হুমকিতে কাজ হয়ে গেলে রক্তপাত না করাই ভাল। আজ তুই দলবল নিয়ে সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়বি। সোজা মামুনগড় শশীরামের বাড়ি। তোর চেনা বাড়ি, অন্ধিসন্ধি সবই জানা। ভয়ডরের ব্যাপার নেই। শশীবাবুর একটা একনলা বন্দুক আছে বটে, তবে সেটা মরচে ধরে গেছে বলেই খবর। পারবি না?”
কাশীবাবু খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে বললেন, “খুব পারব।”
খুশি হওয়ার দুটো কারণ আছে কাশীবাবুর। এক কথা, এত দিন পর বাড়ি যাবেন। দু’নম্বর হল, বাপ-দাদাকে একটা শিক্ষা দিয়ে আসা যাবে। কথাটা ভেবে তিনি বেশ চনমনে বোধ করতে লাগলেন।
রাখালহরি তার দলের দিকে ফিরে বলল, “ওরে তোরা সবাই শোন, মহিষবাথানের জঙ্গল থেকে ছিচকে ডাকাতগুলো আমাকে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, আমার ভাইপো খাঁদু গড়াই নাকি এখন ওদের কজ্জায়, দশ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ পেলে ছেড়ে দেবে। সঙ্গে খাঁদু গড়াইয়ের একটা ছবিও পাঠিয়েছে। মর্কটের মতো দেখতে একটা হাড়গিলে চেহারার লোক। দেখে হেসে বাঁচি না। তা আমার টাকা-পয়সার লোভে অনেকেই এখন আমার ভাইপো হতে চাইবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আমি ওদের জানিয়ে দিয়েছি, ওরা যা খুশি করতে পারে, আমি এক পয়সাও দেব না।”
সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল। খবরটা শুনে কাশীবাবুর কোনও হেলদোল হল না। দুপুরে তিনি মাংস দিয়ে প্রচুর ভাত খেয়ে ঘুমোলেন। তারপর বিকেলে উঠে জীবনে প্রথম ডাকাতির জন্য তৈরি হতে লাগলেন।
ঘড়ি ধরে একেবারে মাহেন্দ্রক্ষণে ঠাকুরমশাই এসে মন্ত্রপাঠ করে সকলের কপালে তেল-সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে প্রসাদী জবাফুল মাথায় ঠেকিয়ে শুভযাত্রায় রওনা করিয়ে দিলেন।
জিপ গাড়িতে উঠে ভারী ফুর্তি হচ্ছিল কাশীবাবুর। এই না হলে জীবন! তিনি গুনগুন করে গাইতে লাগলেন, ‘হারে-রে-রে-রে-রে— আমায় ছেড়ে দে রে, দে রে…’তারপর গাইলেন, ‘কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট…’
চোখে একটু আনন্দাশ্রু এসে গিয়েছিল, সেটা মুছে মন্ত্র স্বরে আবৃত্তি করতে লাগলেন, “আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান, না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ..” তারপর গাইলেন, “উর্ধ্বগগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল…”
মামুনগড়ে তাঁদের বাড়ির সামনে এসে যখন জিপগাড়ি থামল, তখন মোটে রাত আটটা। কমলেকামিনী দেবী ঠাকুরঘরে বসে মালা জপছেন, নবদুর্গা দেবী রান্নাঘরে রাঁধুনিকে তেলকই রান্নার কায়দা শেখাচ্ছেন, নরহরি তার ঘরে বসে সুর করে রামায়ণ পড়ছে, শশীরাম দুধ, খই আর মর্তমান কলা দিয়ে তাঁর নৈশাহার সেরে নিচ্ছেন, আর নসিরাম গাঁয়ের জনাচারেক মাতব্বরের সঙ্গে বাইরের বারান্দায় বসে নিচু স্বরে শলাপরামর্শ করছেন। কাশীরাম যে তিন তিনটে ডাকাতি করেছেন, একথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারেননি তিনি। কাশীকে যে পুলিশে নিয়ে গেছে একথা শুনেও সবাই মুখ টিপে হেসেছেন, কারও প্রত্যয় হয়নি। তবে কাশীরাম যে নিরুদ্দেশ, এতে সকলেই উদবিগ্ন। কেউ বলছেন কাশী বিয়ের ভয়ে পালিয়েছে, কেউ বলছেন যে সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছে, কারও ধারণা বাবা আর দাদুর শাসনে অতিষ্ঠ হয়েই সে বিবাগী হয়ে গেছে।