কীর্তনীয়ারা নাচতে নাচতে এক এক করে তাদের চক্রের মধ্যে প্রথমে কাশীরাম, তারপর নসিরাম, তারপর নরহরি থেকে শুরু করে খাঁদু গড়াই পর্যন্ত সবাইকেই টেনে নিল। কীর্তনটা হচ্ছিলও বেশ ভাল। সুরেলা গলা, তালে তালে উদ্দণ্ড নাচ, মাঝে মাঝে উচ্চকিত হরিবোল হরিবোল’ ধ্বনি, মাঝে মাঝে শাঁখ আর উলু—সব মিলিয়ে একেবারে নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার।
তারপর একসময়ে জয়ধ্বনি দিয়ে কীর্তন স্তিমিত হয়ে শেষ হয়ে গেল। প্রায় টলতে টলতে নসিরাম, শশীরাম, নরহরি আর অন্য পুরুষরা বেরিয়ে এলেন। তারপর কীর্তনের দলটা টপ করে যেন ভভাজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেল। নবদুর্গা দেবী সিধে আর পয়সা দিতে এসে দেখেন, কেউ নেই।
কীর্তনের দলের সঙ্গে খাঁদু গড়াইও যে অদৃশ্য হয়েছে এটা প্রথমে কেউ টের পায়নি। টের পেল রাত্রে খাওয়ার ডাক পড়ার পর। নসিরাম হাঁকডাক করতে লাগলেন, “ওরে, খাঁদু কোথায় গেল দ্যাখ তো! পালাল নাকি?”
নবদুর্গাও চেঁচামেচি করতে লাগলেন, “পালাবে না! দ্যাখো খোঁজ নিয়ে, পোঁটলা বেঁধে সব নিয়ে গিয়েছে কিনা। যেমন তোমার আক্কেল!”
৬. ইদানীং কানাইদারোগা
ইদানীং কানাইদারোগার দিনে বা রাতে মোটেই ঘুম হচ্ছে না। একটু ঝিমুনির মতো এলেও বিকট সব স্বপ্ন দেখে চমকে ওঠেন, চটকা ভেঙে যায়। ঘুমের সঙ্গে সঙ্গে খিদেও উধাও। মাংস-পোলাওয়ের দিকেও তাকাতে ইচ্ছে করে না, এতই অরুচি। ফলে তাঁর শরীর শুকোতে শুকোতে একেবারে দরকচা মেরে সিকিভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেকার জামা-প্যান্ট সব ঢলঢলে হচ্ছে বলে দরজিকে দিয়ে ছোট করাতে হয়েছে। ঘনঘন জলতেষ্টা আর বাথরুম পাচ্ছে। গত কালই খবর এসেছে যে, সরকার বাহাদুরের তরফ থেকে রাখালহরিকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরে দিলে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু সেটা কানাইবাবুর পক্ষে কোনও আশার বাণী নয়, বরং আশঙ্কারই কথা। এর অর্থ হল, রাখালহরি যে কতটা ভয়ংকর তা সরকার বাহাদুরও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পুরস্কারের নোটিশটা থানার নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়ার কথা, তার উপর ঢোল সহরত করে প্রচারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু কানাই সাহস করে উঠতে পারেননি। নোটিশ দিলে রাখালহরি পালটা নোটিশ দেবে। যতই ভাবেন ততই মাথা ঝিমঝিম করে। ডাক্তার বলেছে, রক্তচাপ খুব বেশি, উত্তেজনা একদম বারণ।। |||||||||| আগে একজোড়া বেশ পুরুষ্টু গোঁফ ছিল কানাইবাবুর। অনেকটা ঝাঁটার মতো। রোগা হয়ে যাওয়ায় মুখে গোঁফটা মানাচ্ছে না দেখে হেঁটে ছোট করে ফেলেছেন। সকালে থানায় নিজের ঘরে বসে সরু গোঁফে তা দেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন তিনি। এমন সময় বিশাল চেহারার নসিবাবু ভারী হাসি হাসি মুখ করে ঘরে ঢুকে বললেন, “নমস্কার দারোগাবাবু! তা আপনিই এ থানার নতুন দারোগা বুঝি! বেশ বেশ! কানাইদারোগাটা কোনও কাজের ছিল না মশাই! তার আমলেই এ তল্লাটে চুরি-ডাকাতির একেবারে মোচ্ছ। লেগে গিয়েছিল। কী বলব মশাই, আমার ছেলে কাশীরাম তো তিন তিনটে দুর্ধর্ষ ডাকাতি করার পরও দিব্যি গায়ে ফু দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কানাইদারোগা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। এই আপনি এসে তাকে পাকড়াও করলেন। তা তাকে কি সদরে চালান করা হয়েছে নাকি দারোগাবাবু? চালান করাই উচিত। সে অতি বিপজ্জনক লোক।”
কানাইদাবোগা নাক কুঁচকে একটা তাচ্ছিল্যের ফুঃ দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো হাতের ভঙ্গি করে বললেন, “হুঁ, কাশীরাম করবে ডাকাতি! এ যে বানরে সংগীত গায়, শিলা জলে ভাসি যায়, মশাই! যে রাতে বিড়াল ডাকলে ভয় পায়, দু’কেজি মাল টানতে হাঁপিয়ে পড়ে, বিশ কদম হাঁটতে গিয়ে টাল্লা খায়, সে করবে ডাকাতি! তাও একটা-দুটো নয়, তিনটে! সত্যযুগ এসে গেল নাকি মশাই?”
নসিবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, “আহা, কার ভিতরে কোন প্রতিভা লুকিয়ে আছে তা কি বাইরে থেকে টপ করে বোঝা যায় ? কিন্তু আপনি নতুন মানুষ, কাশীরাম সম্পর্কে এত কথা জানলেন কী করে?”
কানাইবাবু খ্যাঁক করে উঠে বললেন, “কে বলেছে আমি নতুন মানুষ? আমিই কানাইদারোগা। আপনি চোখের ডাক্তার দেখান।”
নসিরাম হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “ইস, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে তো! ভাল করে দেখে এখন আপনাকে কানাইদারোগা বলেই মনে হচ্ছে যেন! তা এই তত দিন বিশেক হল কাশীরামকে আপনার সেপাইরা গিয়ে ধরে নিয়ে এল! রীতিমতো ওয়ারেন্ট দেখিয়ে। এখন বললেই হল যে তাকে ধরা হয়নি?”
কানাইদারোগা ফুঁসে উঠে বললেন, “আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে, কাশীরামকে ধরতে যাব! ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ কানাইদারোগা করে না। আমার এখন পাহাড়-পর্বতের মতো বিরাট বিরাট ডাকাত নিয়ে কারবার। আপনার ওই ননির পুতুল ছেলে কাশীরামকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। বিশ্বাস না হয়, নিজেই গিয়ে লকআপটা দেখে আসুন। দু’জন ছিচকে চোর ছাড়া আর কেউ নেই।”
নসিরাম মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “সর্বনাশ! তা হলে কাশী গেল কোথায়? তাকে লকআপে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়নি তো?”
গম্ভীর হয়ে কানাইদারোগো বললেন, “দেখুন নসিবাবু, পুলিশেরও ঘেন্নাপিত্তি আছে। যে ফুলের ঘায়ে মূৰ্ছা যায় তাকে ধরে এনে পেটানোর মতো আহাম্মক তারা নয়। ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখুন গে, হয়তো বুচিকে বিয়ে করার ভয়ে কোথাও গিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে।”