শশীরাম পুলিশ অফিসারটিকে ভারী বন্ধুর মতো বললেন, “শোনো বাবারা, জাঁতা পেষাই করাবে, পাথর ভাঙাবে, ঘানিগাছে ঘোরাবে। কোনওটা যেন ফাঁক না যায়। একেবারে মজবুত করে গড়ে দাও তো বাবা ছেলেটাকে।”
ছোকরা মুচকি হেসে বলল, “ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমাদের হাতে পড়লে দু’দিন পরেই এঁর ভোল পালটে যাবে।”
“খুব ভাল, খুব ভাল, তা তোমরা দুর্গা দুর্গা বলে এসো গিয়ে। দেরি করে কাজ নেই। শুভ কাজে কখন কী বাধা এসে পড়ে, বলা তো যায় না।”
নরহরিও হাঁপাতে হাঁপাতে রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়ে গেল। চারজন পুলিশ টপাটপ রসগোল্লা সাফ করে দিল কয়েক মিনিটেই। তারপর জিপে উঠে কাশীবাবুকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
কমলেকামিনী দেবী এবং নবদুর্গা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
জিপে দু’জন পুলিশের মাঝখানে বসে কাশীবাবুর মাথাটা ফের ডোম্বল হয়ে গেল। এতক্ষণ যা দেখলেন, যা শুনলেন, তা কি বিশ্বাসযোগ্য? তাঁর বাবা নসিরাম এবং দাদু শশীরাম কি আসলে তাঁর কেউ নন। তিনি কি কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে? নইলে তাঁর এই ভয়ংকর বিপদের দিনে নসিরাম এবং শশীরাম এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেন কী করে? তিনি যখন ঘোর বিপন্ন, তখন শ্রদ্ধেয় শশীরাম ও শ্রদ্ধেয় নসিরামের এত স্ফুর্তি আসে কী করে? এ তো সেই রাজা নিবোর মতো আচরণ, যখন রোম পুড়ছে তখন নিরো আহ্লাদে তারবাদ্য বাজাচ্ছিলেন। ছিঃ ছিঃ, পূজ্যপাদ শশীরাম ও পূজনীয় নসিরাম সম্পর্কে তাঁর সব পূর্ব ধারণা যে তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ল! এর পরও যদি বেঁচে থাকেন, তবে কাশীরাম হয়তো শশীরামকে ‘দাদু এবং নসিরামকে ‘বাবা’ বলে ডাকবেন, কিন্তু সেই ডাক কি আর অন্তরের অন্তস্তল থেকে উঠে আসবে?
মনের দুঃখে এত অভিভূত হয়েছিলেন কাশীবাবু যে, জিপটা তাঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে লক্ষই করলেন না। যেখানে খুশি নিক, তাঁর কিছু আসে যায় না। পৃথিবীকে তাঁর চেনা হয়ে গিয়েছে। দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস নেই। এখন পুলিশ তাঁকে ফাঁসিতে লটকালেও তিনি বিশেষ আপত্তি করবেন না। এবং তাঁর এমন সন্দেহও হচ্ছে যে, তাঁর ফাঁসি হয়েছে শুনলে শ্রদ্ধাস্পদ শশীরাম এবং পুণ্যশ্লোক নসিরাম হয়তো বা আনন্দের চোটে হরির লুট দিয়ে বসবেন।
একটা ঘোর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে জিপটা নানা বাঁক নিয়ে, খানাখন্দ পেরিয়ে, ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে একটা দুর্গম জায়গায় এসে থামল। একজন পুলিশ তাঁর হাতকড়া আর দড়ি খুলে দিয়ে হাতজোড় করে বলল, “অপরাধ নেবেন না। আপনার খুড়োমশাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আসুন।”
কাশীরাম আর অবাক হচ্ছেন না। আজ দুপুর থেকে তিনি বারবার এত অবাক হয়েছেন যে, আর অবাক হওয়া সম্ভব নয়। অবাক হওয়ারও তো একটা শেষ আছে রে বাবা! তবে তিনি যত দূর জানেন, তাঁর বড়খুড়ো বাঞ্ছারাম বামুনগাছিতে এবং ছোটখুড়ো হরেরাম হরিদ্বারে থাকেন। এই নীলপুরের জঙ্গলে থাকার মতো বাড়তি খুড়ো তাঁর নেই। তবু তাতেই বা কী যায়-আসে। নিজের বাপ-দাদাই যদি এমন পর হয়ে যান, তা হলে খুড়ো নিয়ে মাথাব্যথা কীসের?
জিপ থেকে নেমে তিনি চারটে লোকের পিছু পিছু বেশ গটগট করে হেঁটে গিয়ে একটা গোলপাতার ছাউনিওয়ালা ঘরে ঢুকে একজন লম্বা পাঠানি চেহারার লোকের সামনের দাঁড়ালেন।
“আপনার ভাইপোকে এনেছি কর্তা। ইনিই খাঁদু গড়াই।”
পাঠানি লোকটা বলল, “কানের পিছনকার দাগটা দেখে নিয়েছিস তো!”
“যে আজ্ঞে। এই যে।” বলে লোকটা টর্চ ফোকাস করে কাশীবাবুর বাঁ কানের লতিটা উলটে দিয়ে দেখাল। কাশীবাবু আপত্তি করলেন না।
পিছন থেকে কে একজন কাশীবাবুর কোমরে একটা গুঁতো দিয়ে বলল, “পেন্নাম করুন। ইনি আপনার পূজনীয় খুড়োমশাই শ্রীরাখালহরি গড়াই।”
একথায় কাশীবাবু আপত্তিকর কিছুই খুঁজে পেলেন না। দুনিয়ার উপর, জীবনের উপর এমনই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন যে, এই আখাম্বা লোকটাকে মাসি’ বলে ডাকতে হলেও তিনি রাজি। সবাই যখন পর, তখন ডাকে আর কী আসে-যায়। তিনি তাড়াতাড়ি রাখালহরিকে প্রণাম করে ফেললেন।
রাখালহরি বাঘা হাতে তাঁর পিঠ চাপড়ে বলল, “বাঃ, বেশ! বেশ।”
কাশীবাবু বিলক্ষণ জানেন যে, তিনি খাঁদু গড়াই নন এবং এই লোকটা কস্মিনকালেও তাঁর খুড়ো নন। তাঁর দুই খুড়ো হরেরাম ও বাঞ্ছারাম ডাকাবুকো হলেও ডাকাত নন। কিন্তু আজ তাঁর দুনিয়াটাই পালটে গিয়েছে।
রাখালহরি অতি তীক্ষ্ণ এবং সন্ধানী নয়নে কাশীরামকে যেন কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল, “নাঃ, এ বড় নধর চেহারা। ঘি-দুধ খাওয়া শরীর, কসরতের কোনও চিহ্নই নেই। ওরে হাবু, কাল থেকেই একে তৈরি করতে লেগে যা বাবা। কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়তি চর্বি ঝরিয়ে একটু চাঙা করে দিবি। সনাতন আর গাব্ব একটু প্যাঁচপয়জার শেখাবে। গদাই বন্দুক-পিস্তলের তালিম দেবে। আর কালীকেষ্ট শেখাবে কম্পিউটার। আর শোন, ওর ভাল নাম হল ক্ষুদিরাম, ‘খাঁদু’ বলে কেউ ডাকবি না। ও নামে শুধু আমি ডাকব।”
নীলপুরের জঙ্গলে যখন এই কাণ্ড চলছে, তখন মামুনগড় গাঁয়ে শশীরামের বাড়িতে এক বিরাট কীর্তনের দল এসে হাজির। প্রায় পনেরো-যোলোটা খোল, মেলা করতাল, কাঁসি, ঢোল বাজিয়ে সে একেবারে উদ্দণ্ড তারকব্রহ্ম নাম। বাড়িসন্ধু লোক বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে। এমনকী চোখের জল মুছতে মুছতে কমলেকামিনী দেবী এবং নবদুর্গা দেবীও। বাড়ির কাজের লোকজন, আত্মীয় বন্ধু সবাই জুটে গেছেন। এমনকী খাঁদু গড়াইও।