বলেই লোকটা কাশীবাবুর হাতে একজোড়া হাতকড়া পরিয়ে দিল, অন্য একজন একটা মোটা দড়ির এক প্রান্ত চট করে কোমরে বেঁধে ফেলল।
কাশীবাবু এবার যেন মাটিতে পা রাখলেন। ভারী অবাক হয়ে বললেন, “এসব হচ্ছে কী? আঁ! এসব কী ব্যাপার?”
আর ঠিক এই সময়েই কাশীবাবুর দাদু শশীরাম তাঁর বৈকালিক ভ্রমণ সেরে ফিরে ফটক খুলে ঢুকেই পুলিশ দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তিনি বিশাল মাপের পুরুষ, হাতে মোটা লাঠি, বাজখাই গলায় বললেন, “আমার বাড়িতে পুলিশ কেন হে? কী হয়েছে?”
কর্তাগোছের লোকটা বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আমরা এঁকে অ্যারেস্ট করতে এসেছি। এই যে ওয়ারেন্ট।”
শশীরাম ওয়ারেন্টের কাগজখানাকে মোটে গ্রাহ্যই করলেন না। গলাটা নামিয়ে বললেন, “ওরে বাপু, চার্জটা কীসের সেটা বললেই তো হয়।”
“আজ্ঞে, ডাকাতির। তিন-তিনটে দুর্ধর্ষ দুঃসাহসিক ডাকাতি।”
শশীরাম বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলো কী হে? সত্যি নাকি? না মশকরা করছ?”
“আজ্ঞে, মশকরা নয়।”
শশীরাম ভারী আহ্লাদের সঙ্গে একগাল হেসে বললেন, “ডাকাতির কেস, ঠিক তো!”
“আজ্ঞে, ডাকাতির কেসই।”
শশীরাম আহ্লাদে ফেটে পড়ে লাঠিন্ধু দু’হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “জয় মা কালী! জয় করালবদনী! এত দিনে মুখ তুলে চাইলে মা! ওরে ও নসে! ও গিন্নি! ও বউমা! আরে তোমরা সব ছুটে এসো। দ্যাখো, আমাদের কেশো কী কাণ্ড করেছে। আগেই জানতুম, এই বীরের বংশে কাপুরুষ জন্মাতেই পারে না!”
হাঁকডাকে নসিরাম ছুটে এলেন। পিছু পিছু কাশীবাবুর ঠাকুরমা কমলেকামিনী দেবী, মা নবদুর্গা।।
নাতির অবস্থা দেখে কমলেকামিনী দেবী ডুকরে উঠলেন, “ওরে এই অলপ্পেয়ে মিনসেগুলো কে রে, আমার কেশোকে অমন করে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধেছে! আঁশবটিটা নিয়ে আয় তো রে মালতী, দেখি ওদের মুবোদ!”
শশীরাম গর্জে উঠে বললেন, “খবরদার, ওসব কোরো না। ওরা আইনমাফিক কাজ করছে। যাও বরং, শাঁখটা নিয়ে এসো। শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি করো সবাই। এত দিনে ব্যাটা বুকের পাটা দেখিয়েছে!”
কমলেকামিনী দেবী আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “শাঁখ বাজাব! উলু দেব! কেন, কোন মোচ্ছব লেগেছে শুনি! আমার দুধের বাছাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ! আজ কোথায় তোমার বীরত্ব? হাতের লাঠিগাছা দিয়ে দাও না ঘা কতক।”
শশীরাম মাথা নেড়ে বললেন, “না, না, ও তুমি বুঝবে না। স্নেহে অন্ধ হলে কি এসব বোঝা যায়! এত দিনে তোমার কেশো মানুষের মতো মানুষ হল, বুঝলে! ওই ম্যাদামারা, নাদুসনুদুস, অপদার্থ, কাপুরুষ ছেলে কি এবংশে মানায়! আজ ছাইচাপা আগুন বেরিয়ে পড়েছে গিন্নি, আজ দুঃখের দিন নয়, আনন্দের দিন।”
নসিরাম প্রথমটায় ব্যাপার বুঝতে পারেননি। এখন খানিকটা বুঝে তিনিও গোঁফ চুমরে বললেন, “ডাকাতি করেছে নাকি ব্যাটা?”
শশীরাম বুক চিতিয়ে বললেন, “তবে! ডাকাতি বলে ডাকাতি? তিন-তিনটে দুর্ধর্ষ ডাকাতি। এই তো পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে দ্যাখো না।”
নসিরাম পুলিশের সদারকে বললেন, “সত্যি নাকি?”
“যে আজ্ঞে।” কাশীরাম এতক্ষণে ফাঁক পেয়ে বললেন, “না, না, এসব বানানো গল্প।”
নসিরাম গর্জন করে বললেন, “চোপ! ডাকাতি করেছিস তো করেছিস। তার জন্য অত মিনমিন করে কাঁদুনি গাওয়ার কী আছে! বুকের পাটা আছে বলেই করেছিস। মাথা উঁচু করে জেল খেটে আয় তো দেখি!”
নসিরাম আহ্লাদে ফেটে পড়ে বললেন, “আহা, ডাকাতি তেমন খারাপ জিনিসই বা হতে যাবে কেন? চেঙ্গিস খাঁ থেকে আলেকজান্ডার, সুলতান মামুদ থেকে ভাস্কো ডা গামা, কে ডাকাত নয় রে বাপু? আগেকার রাজারাজড়ারাও তো বাপু, বকলমে ডাকাত ছাড়া কিছু নয়। রবিন হুডকে নিয়ে তবে নাচানাচি হয় কেন? ও গিন্নি, ওকে বরং একটা চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দাও। ওরে তোরা শাঁখ বাজা, উলু দে, পাঁচজনে জানুক।”
নবদুর্গা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “ও যে রাতে দুধভাত খায়, নরম বিছানা ছাড়া শুতে পারে না, ভূতের ভয়ে একলাটি থাকতে পারে না, জেলখানায় গেলে কি ও আর বাঁচবে। সেখানে লপসি খাওয়ায়, কুটকুটে কম্বলের উপর শুতে দেয়, মারধর করে। খবর রটলে যে বিনয়বাবু বঁচির সঙ্গে ওর বিয়ে ভেঙে দেবেন।”
শশীরাম মোলায়েম গলায় বললেন, “বীরের জননী হয়ে কি তোমার এসব বিলাপ মানায় বউমা? আপাতদৃষ্টিতে ডাকাতি জিনিসটা ভাল নয় বটে, কিন্তু এ তো ভেড়ুয়াদের কাজ নয় বউমা। পুরুষকার লাগে। কেশোর ভিতরে যে পুরুষকার জেগেছে তা কি টের পাচ্ছ? আহা, আজ যে আনন্দে আমার চোখে জল আসছে!”
বলে শশীরাম ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন। নসিরাম পুলিশের দিকে চেয়ে বললেন, “ওহে বাপু, তোমাকে তো ঠিক চেনা চেনা ঠেকছে না!”
“আজ্ঞে, এই সবে নতুন বদলি হয়ে এসেছি।”
“আর তোমাদের কানাইদারোগা ! সে এল না?”
“আজ্ঞে, তিনি আর-একটা থানায় বদলি হয়ে গেছেন।”
শশীরাম বললেন, “খুব ভাল হয়েছে। কানাইদারোগা কোনও কম্মের নয়। ওরে বাপু, তোর নাকের ডগায় একটা লোক তিন তিনটে ডাকাতি করে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তোর হুঁশই নেই! ওহে বাপু, তোমাদের একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছাড়ছি না। ওরে নরহরি, যা তো, দৌড়ে গিয়ে হারুময়রার দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে আয়।”
নরহরি পড়ি-কি-মরি করে ছুটল।