কাশীবাবুর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, এবাড়িতে যে এত গয়না আর টাকা আছে, এ-খবর তাঁরও জানা ছিল না। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “তু-তুমি এ-এসব জা-জানলে কী কী করে?”
“সে আর শক্ত কী? চোখ আর মগজ থাকলেই জানা যায়। কর্তাবাবারই কী আক্কেল বলুন, দুটো মন-রাখা কথা কইতেই উনি একেবারে গলে গিয়ে আমাকে খাতির করে প্রায় অন্দরমহলে ঢুকিয়ে ফেলেছেন।”
কাশীবাবু কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, “তা হলে উপায়?”
“আমি বলি কী কাশীবাবু, আপনি খুব হুঁশিয়ার হয়ে আমার উপর নজর রাখুন। এই ধরুন, আমি সারাদিন কী করি, বাইরের কেউ আমার কাছে যাতায়াত করে কিনা, ঠারেঠোরে বা ইশারা ইঙ্গিতে কাউকে খবরাখবর পাঠাচ্ছি কিনা, তারপর ধরুন, আমি লোকটা কেমন, হাঁ করে ঘুমোই কিনা, নাক ডাকে কিনা…”
কাশীবাবু সোৎসাহে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্বিজপদ তো এসব কথাই বলেছিল!”
বলেই কাশীবাবু জিভ কাটলেন। এঃ হেঃ, দ্বিজপদর কথাটা বেফাঁস বেরিয়ে গিয়েছে। সামাল দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, “না, না তোমার কথা হচ্ছিল না হে, এই চোর-ছ্যাঁচোড়দের কথাই হচ্ছিল আর কী!”
খাঁদু মাথা নেড়ে বলে, “আহা, আমার কথা হলেই বা দোষ কী? ভাল লোক তো কারও গায়ে লেখা থাকে না মশাই। চোখে চোখে রাখাই বিচক্ষণতার কাজ। উঁকিঝুকি মারারও কোনও দরকার নেই। সোজা এসে আমার নাকের ডগায় গেড়ে বসে বলবেন, তোমার উপর নজর রাখছি হে।”
কাশীবাবু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “সেটা কি ভাল দেখাবে? তুমি তো কিছু মনে করতেও পারো!”
“না, মশাই না। আনাড়ি লোকদের শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে আমি বড় ভালবাসি। গোলমেলে লোকদের উপর কী করে নজর রাখতে হয়, কী করে তাদের পেটের কথা টেনে বের করতে হয়, তার দু চারটে কায়দা আপনাকে শিখিয়ে দেব’খন।”
কাশীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্বিজপদও এরকমই কী যেন বলছিল।”
“পাকা মাথার লোক তো বলবেই। তবে কিনা নজর রাখাও বড় চাট্টিখানি কথা নয়। আপনি হয়তো উকি দিয়ে দেখলেন, আমি বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়ে হাঁ করে ঘুমোচ্ছি। ভাবলেন, আহা, খাঁদু ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোক, আমিও গিয়ে তা হলে একটু গড়িয়ে নিই। ব্যস, ওইখানে মস্ত ভুল করে ফেললেন। ওই যে বাঁ দিকে কাত হয়ে শোওয়া, হাঁ করে থাকা, ও-সবই হচ্ছে নানারকম সংকেত, ওর ভিতর দিয়েই কথা চালাচালি হয়ে যাচ্ছে, আপনি ধরতেও পারলেন না।”
“অ্যাঁ!” বলে মস্ত হাঁ করলেন কাশীবাবু।
“হ্যাঁ মশাই, শুধু কি তাই, যদি নাক ডাকে তা হলে জানবেন ওই সঙ্গে আরও মেসেজ চলে গেল। নাক ডাকারও আলাদা অর্থ আছে, যা আপনার জানা নেই। তারপর ধরুন, আমি হয়তো বসে বসে হাই তুলছি বা আঙুল মটকাচ্ছি বা আড়মোড়া ভাঙছি, ভুলেও ভাববেন না যে, আলসেমি করছি। ও সবই হল নানারকম ইশারা ইঙ্গিত। আপনি যেমন আমার উপর নজর রাখছেন, তেমনই বাইরে ওই পাঁচিলের উপর বা ঝুপসি আমগাছের ডালপালার ভিতর থেকে দুরবিন কষে আর কেউও আমার দিকে নজর রাখছে। আর সব টুকে নিচ্ছে।”
কাশীবাবু এত অবাক আর বিহ্বল হয়ে গেলেন যে, তাঁর মুখ দিয়ে প্রথমটায় কোনও কথাই বেরোল না। কী সাংঘাতিক লোকের পাল্লায় পড়েছেন তা ভেবে তাঁর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। অনেকক্ষণ পরে শুধু বলতে পারলেন, “ওরে বাবা!”
“তাই বলছি আমি থাকতে থাকতে সব শিখে নিন। দিনকাল যা পড়েছে, চারদিকে চোখ না রাখলে যে বিপদ!”
৫. কাশীবাবু সামনের বাগানে
ঘণ্টাখানেক পরে যখন কাশীবাবু সামনের বাগানে একটা মোড়া পেতে বসে আছেন, তখনও তাঁর মাথাটা ভোম্বল হয়ে আছে। চোখের সামনে যা আছে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর মাথার মধ্যে কেবল ঘুরছে, বাঁ পাশে কাত হয়ে হাঁ করে ঘুমালে এক রকম সংকেত, নাক ডাকলে তার এক অর্থ, হাই তুললে আবার অন্য ইশারা, আঙুল মটকালে বা আড়মোড়া ভাঙলে আর-এক ইঙ্গিত, এই সংকেতময় নতুন বিষয়টা অনুধাবন করার পর তাঁর বাহ্যজ্ঞান নেই। ওঃ, পৃথিবীতে কত কিছু শেখার আছে। ওকালতি পাশ করে তাঁর তো তেমন জ্ঞানার্জনই হয়নি! এই যে নতুন একটা জগতের দরজা তাঁর সামনে খুলে দিল খাঁদু, তার বিস্ময়, তার রোমাঞ্চই আলাদা। কাশীরাম আজ অভিভূত, বিস্মিত, বাকরহিত।
এরকম তুরীয় অবস্থা না হলে কাশীবাবু ঠিকই টের পেতেন যে, তাঁদের বাড়ির সামনে এই পড়ন্ত বিকেলে একটা পুলিশের জিপ এসে থামল। পুলিশের ইউনিফর্ম পরা চারজন লোক নিঃশব্দে নেমে ফটক খুলে ভিতরে ঢুকল। অগ্রবর্তী লোকটার হাতে একটা
কম্পিউটারে আঁকা ছবি, সে বাগানে ঢুকেই সামনে সম্পূর্ণ আনমনা কাশীবাবুকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ছবিটার সঙ্গে তাঁর চেহারাটা মিলিয়ে বলে উঠল, “এই তো!”
বাকি তিনজনও ছবিটা দেখে কাশীবাবুর সঙ্গে চেহারার আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করে খুশি হয়ে বলল, “বাঃ, মেহনতই করতে হল না।”
“তবু কানের দাগটা দেখে নেওয়া ভাল। ভুল হলে সর্দার আস্ত রাখবে না।”
একজন গিয়ে কাশীবাবুর পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর কানটা উলটে দেখে নিয়ে বলল, “বাঃ, এই তো কাটা দাগ!”
এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও কাশীবাবু কিছুই টের পেলেন না। শুধু বাঁ কানে একবার হাত বুলিয়ে গভীর অন্যমনস্কতার সঙ্গে বললেন, “ও কিছু নয়। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ধরতে গিয়ে মাঞ্জা সুতোয় কেটে গিয়েছিল!”
সর্দার গোছের পুলিশটা এগিয়ে এসে বলল, “পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ। আপনাকে আমরা একটা ডাকাতির চার্জে অ্যারেস্ট করতে এসেছি।”