ঠাকুরমা প্রায়ই বলেন, “ভয়-ভীতি থাকাই তো ভাল। তোর বাপু, বাপ-দাদার মতো আহাম্মক হওয়ার দরকার কী? তোর দাদু বীরত্ব ফলাতে গিয়ে তো কতবার মরতে বসেছে। সেবার হিরু গুন্ডার দায়ের কোপে গলা অর্ধেক নেমে গিয়েছিল। বাঁচার কথাই নয়। শশধর ডাক্তার আর পাঁচকড়ি কবরেজের মতো ধন্বন্তরি ছিল বলে, গলা জোড়া লাগল। তোর বাপেরই কি বুদ্ধিসুদ্ধি আছে? গোলা বারুদের সামনে বুক চিতিয়ে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে কতবার মরতে বসেছে। এখনও নাকি একটা গুলি পাঁজরে সেঁধিয়ে আছে, বের করা যায়নি।”
মা বলেন, “তুই যেমন আছিস তেমনই থাক বাবা, অন্যরকম হয়ে কাজ নেই তোর। তোর বাপ-দাদার হল ষণ্ডা-গুন্ডার ধাত, ভদ্দরলোকদের ওরকম হওয়ার তো কথাই নয়।”
কিন্তু সমস্যা হল বিজয়বাবু। দুর্ভাগ্যবশত তিনি একজন বীরপূজারি। বীর জামাই না হলে মেয়ের বিয়েই দেবেন না। তাই শশীরামের নাতি আর নসিরামের ছেলে এই কাশীরামকে মেয়ে বঁচির জন্য দেগে রেখেছেন।
সম্বন্ধটা এনেছে দ্বিজপদ। শশীরাম একদিন দ্বিজপদকে ডেকে বলেছিলেন, “তুই তো ঘটকালিও করিস। দ্যাখ তো বাবা, ডাকাবুকো, ডানপিটে হান্টারওয়ালি গোছের একটা মেয়ে পাস কিনা। আমার অপোগণ্ড, ভিতুর ডিম, কাপুরুষ নাতিকে ওই মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দেব। ডাকাবুকো একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে যদি ওর একটু উন্নতি হয়।”
তা বুচিকে সকলেরই খুব পছন্দ। সে নাকি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়। বন্দুক-পিস্তলে অব্যর্থ হাত, যুযুৎসু জানে, স্কুলের স্পোর্টসে গাদা গাদা প্রাইজ পায়। কুঁচির বিবরণ শুনে কাশীবাবু খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। বিয়েটা ভেঙে দেওয়ারও ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু সে-কথা ধানাইপানাই করে ব্যক্ত করার পরই মা হুমকি দিলেন, বাপের বাড়ি চলে যাবেন, ঠাকুরমা কাশীবাসী হওয়ার সতর্কবার্তা জারি করলেন, বাবা আর দাদু সন্ন্যাস নেওয়ার কথা আগাম ঘোষণা করে দিলেন। অগত্যা কাশীরামকে প্রস্তাবটা মেনে নিতে হয়েছে।
গত কাল থেকে খাঁদু গড়াই তাদের বাড়িতে বহাল তবিয়তে রয়েছে। কাশীরামের মাথায় আসছে না, তার বাবামশাই নসিরাম কেন খাঁদুকে একজন ডাকসাইটে ডাকাত বানানোর জন্য মেহনত করছেন। ডাকাত কি সমাজবিরোধী নয়? ইন্ডিয়ান পেনাল কোড কি ডাকাতিকে বিধিসম্মত পেশা হিসেবে স্বীকার করে ? কিন্তু নসিরামকে কার সাধ্য সেকথা বোঝায়? ওঁর গোঁ, খাঁদুকে এমন ডাকাত বানাবেন যে, পরগনার অন্য সব ডাকাত জব্দ হয়ে যাবে।
খাঁদু দিব্যি ডেঁড়েমুশে খাচ্ছোচ্ছে, দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে বাড়ির মধ্যে ঘুরঘুর করছে। আর যতই খাদু গেড়ে বসছে ততই কাশীবাবু নার্ভাস বোধ করছেন। খাঁদুর জন্য যে এ বাড়িতে যে কোনও সময়ে রাখালহরি বা রাখালহরির প্রতিপক্ষ হামলা করতে পারে, এটা জেনে ইস্তক কাশীবাবুর খাওয়া অর্ধেক এবং ঘুম সিকিভাগ হয়ে গিয়েছে। তার উপর নজর রাখার মোটেই ইচ্ছে ছিল
কাশীরামের। কিন্তু দ্বিজপদ বিপদের ভয় দেখিয়ে রেখেছে, বিজয়বাবুকে বলে দেবে।
ঘনঘন জল খেয়ে, বারকয়েক বাথরুম ঘুরে এবং গোপনে একটু ডনবৈঠক দেওয়ার পর কাশীবাবু খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে নীচের তলার একটেরে ঘরটার শিয়রের জানালার কাছে গিয়ে আড়াল হয়ে দাড়ালেন। তারপর অতি সাবধানে একটা চোখ দিয়ে ভিতরে দৃষ্টিক্ষেপ করলেন না, ভয়ের কিছু নেই। দুপুরে মাংস-ভাত খেয়ে খাঁদু দিব্যি মাদুরে হাতে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। নজর রাখতে কোনও ভয় নেই।
সবে বুকে একটু সাহস ফিরে আসছিল, ঠিক এই সময়ে খাদু তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল, “কাশীবাবু যে! কী সৌভাগ্য! আসুন! আসুন!”
কাশীবাবু ভারী অপ্রস্তুত। খাঁদু গড়াইয়ের মাথার তালুতে কি তৃতীয় নয়ন আছে? নইলে তাকে দেখল কী করে?
খাঁদু উঠে বসে তার দিকে চেয়ে লাজুক হেসে বলে, “আজ্ঞে, আস্তাজ্ঞে হোক, বস্তাজ্ঞে হোক।”
কুষ্ঠিত পায়ে এবং উৎকণ্ঠিত মুখে কাশীবাবু ঘরে ঢুকে আমতা আমতা করে বললেন, “তা ইয়ে, বলছিলাম কী, তোমার কোনও অসুবিধে টসুবিধে হচ্ছে না তো!”
খাঁদু চোখ বড় বড় করে বলে, “বলেন কী মশাই, অসুবিধে কীসের? তোফা আছি। দোবেলা ফাঁসির খাওয়া খাচ্ছি, ঘুমও হচ্ছে মড়ার মতো, না মশাই, আপনাদের অতিথি-সকারের নিন্দে কেউ করতে পারবে না। তা কাশীবাবু, মাতব্বরদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে এসেছেন তো!”
কাশীবাবু অবাক হয়ে বললেন, “কীসের শলাপরামর্শ? কে মাতব্বর?”
খাঁদু ডবল অবাক হয়ে বলে, “করেননি? সে কী মশাই? এই যে আমি একটা উটকো লোক হুট করে আপনাদের বাড়িতে ঢুকে পড়লুম, এটা কি ভাল হল? তার উপর লোকটা এক সাংঘাতিক ডাকাতের ভাইপো। না মশাই, এরকম ঘটনা ঘটলে মুরুব্বি মাতব্বরদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করাই তো উচিত। কী থেকে কী হয় তা তো বলা যায় না। দিনকাল মোটেই ভাল নয়। ভালমানুষ বলে মনে হলেও আসলে আমি কেমন মানুষ, কোন মতলব আঁটছি, এসব খতিয়ে না দেখাটা আপনার উচিত হচ্ছে না।”
কাশীবাবু ফাঁপরে পড়ে বললেন, “তা ইয়ে, তা কাল সকালে যে তুমি বলেছিলে, তুমি ধর্মভীরু লোক!”
খাঁদু গম্ভীর হয়ে গলা নামিয়ে বলল, “আহা, আমি বললেই আপনি সেকথা বিশ্বাস করবেন কেন? আজকাল কি কাউকে বিশ্বাস করতে আছে মশাই? ধরুন কেন, আপনার মা ঠাকরুনের গলার বিছোরখানার না হোক দশ বারো ভরি ওজন, আপনার ঠাকুরমা ঠাকরুনের বালাজোড়াও, তা ধরুন, পনেরো ভরির নীচে হবে না। তারপর ধরুন আলমারির লকারে, সিন্দুকে, পাটাতনের উপর পুরনো ন্যাকড়ার পুঁটলিতে, আরও ধরুন, এক-দেড়শো ভরি গয়না তো আছেই। আর নগদ টাকাই কিছু ফ্যালনা হল! বুড়ো কর্তার হাতবাক্সে সবসময় দশ-বিশ হাজার টাকা মজুত। কর্তাবাবার লোশকের তলায় তো টাকার হরির লুট। তাই বলছি, বাইরের অজানা-অচেনা লোককে ঠাঁই দিয়ে যে আতান্তরে পড়বেন মশাই!”