সভায় প্রবল হাততালি পড়ল। আর ঠিক এই সময়ে বিরিয়ানিতে গোলাপজল আর কেশর পড়ায় ভারী সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
সভাস্থল থেকে মাইলসাতেক দুরে নীলপুরের গভীর জঙ্গলের মধ্যে গোলপাতার একটা বড় ছাউনির ভিতরে হেডফোনটা কান থেকে খুলে রাখল রাখালহরি। তিপ্পান্ন বছর বয়সেও তার চেহারায় বিন্দুমাত্র মেদ নেই। ছিপছিপে চাবুকের মতো শরীর, রীতিমতো মাসকুলার হাত-পা।
ঘরের এক কোণে বসে একজন বেঁটেখাটো লোক কম্পিউটারে একটা মুখের ছবি আঁকার চেষ্টা করছিল। তার দিকে চেয়ে রাখালহরি বলল, “তোর হল রে কালীকেষ্ট?”
কালীকেষ্ট মৃদু স্বরে বলল, “আজ্ঞে, হয়ে এল। মুশকিল হল, আপনি যখন আপনার ভাইপোকে শেষবার দেখেন, তখন তার বয়স সাত-আট বছর, সে বয়সের চেহারার বিবরণ ধরে তার এখনকার মুখের আদল আন্দাজ করে যা দাঁড়াচ্ছে, তা কি আপনার পছন্দ হবে?”
রাখালহরি গম্ভীর গলায় বলে, “দেখি, একটা প্রিন্ট বের করে দেখা তো।”
কালীকেষ্ট একটা প্রিন্ট নিয়ে এলে রাখালহরি সেটা দেখে মমাটেই পছন্দ করল না। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল, “না, আমার মতো হয়নি ব্যাটা। মুখে সেই হারমাদের ভাবটাই নেই, চোখের চাউনিও তো মরা মাছের মতো। ব্যাটা ওর বাপের মতোই হয়েছে তা হলে। দাদা চিরকালই ভেডুয়া টাইপের ছিল।”
“যদি বলেন তা হলে একটা জম্পেশ গোঁফ লাগিয়ে দিতে পারি।”
“তাতে লাভ কী! লোকটা তো তাতে বদলাবে না। যাক গে, কী আর করা যাবে। শত হলেও রক্তের সম্পর্ক। একেই গড়েপিটে নিতে হবে।”
“আজ্ঞে, সে আর বেশি কথা কী? আপনি কিলিয়ে কত কাঁঠাল পাকালেন, চোখের সামনেই তো দেখলাম। দেখবেন একদিন, এই গোলগাপ্পা ভাইপোও একদিন গুন্ডাপ্পা হয়ে উঠবে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাখালহরি বলল, “আর সময় নেই, মহিষবাথানের জঙ্গলে ওদের মিটিঙের রিলে শুনছিলাম নয়ন দাসের সেলফোন থেকে। ওরা আজই খাঁদুকে তুলে আনবে। কম্যান্ডো লিস্ট তৈরি হচ্ছে। তার আগেই যদি খাঁদুকে সরিয়ে ফেলা না যায়, তা হলে মুশকিল। তুই এক্ষুনি হাবু, সনাতন, গদাই আর গাব্বকে ডেকে আন।”
“যে আজ্ঞে,” বলে কালীকেষ্ট তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ছাউনির মধ্যে সিংহের মতো পদচারণা করতে করতে রাখালহরি একা-একাই বলতে লাগল, “কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবি, শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। কোটি কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট, বিশাল নেটওয়ার্ক, ম্যান ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স, পাবলিক রিলেশন, অ্যাকাউন্টস, নিউ ভেঞ্চার, অপারেশন, একটিও কি ব্যাটা পারবে সামাল দিতে!”
নিঃশব্দে ছাউনিতে ঢুকে হাবু, সনাতন, গদাই আর গাব্ব ভারী বশংবদ ভঙ্গিতে লাইন দিয়ে দাঁড়াল। আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করে রাখালহরি তাদের সামনে স্থির হয়ে দাড়িয়ে বলল, “অপারেশন খাঁদু। প্ল্যান সিক্স। গাঁয়ের নাম মামুনগড়। কাশীরাম রায়ের বাড়ি। সন্ধে ছ’টার মধ্যে কাজ হাসিল করা চাই। প্রিন্ট আউটের ছবিটা দেখে নে ভাল করে। ছবির সঙ্গে চেহারা না-ও মিলতে পারে। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ধরতে গিয়ে একবার মাঞ্জা সুতোয় খাঁদুর কান কেটে যায়। কানের পিছনে কাটা দাগ দেখবি। সাবধান, ভুল লোককে তুলে আনিস না। আইডেন্টিফিকেশন মার্কটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট।”
“যে আজ্ঞে !”
“আর কোনও প্রশ্ন আছে?”
সনাতন বলল, “যে আজ্ঞে, কোন কান? বা না ডান?”
রাখালহরি ফের কিছুক্ষণ পায়চারি করে বলল, “যত দূর মনে আছে, বাঁ কান। তবে ডান কান হওয়াও বিচিত্র নয়। এবার বেরিয়ে পড়ো।”
চারজন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
রাখালহরি তার ল্যাপটপ খুলে নিবিষ্ট মনে কাজ করতে লাগল।
মাত্র মাইল পনেরো দূরে মামুনগড় গায়ে শশীরাম রায়ের বাড়িতে কাশীরাম রায় খুবই বিপন্ন বোধ করছেন। উঁকিঝুঁকি ব্যাপারটা তার একদম পছন্দ নয়। কেউ আড়াল থেকে লুকিয়ে উঁকি মেরে তাঁকে লক্ষ করছে, এ কথা ভাবলেই তার গা শিরশির করে। এইজন্য ছেলেবেলায় চোর-চোর খেলার সময় তিনি টেনশন সহ্য করতে না পেরে এই যে আমি’ বলে লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে সদর্পে ঘোষণা করে দিতেন। এই উনত্রিশ-ত্রিশ বছর বয়সে ফের সেই ছেলেবেলার টেনশনটা টের পাচ্ছেন তিনি।
দুনিয়াসুদ্ধ লোক যে কেন বীর বা সাহসীদের ভক্ত তা তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না। দুঃসাহসিক কাজ করতে গিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলা কি ভাল? সেটা কি দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ নয়? ভূত-প্রেত, গুন্ডা বদমাশ, মারকুটে বা রাগী লোক, বাঘ ভালুক এসব তো ভয় পাওয়ার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে, নাকি? সুতরাং ভয় পাওয়াটাও তো নিয়মের মধ্যেই পড়ে! কিন্তু তার দাদু শশীরাম বা বাবা নসিরাম তা বোঝেন কই? দাদু শশীরাম প্রায়ই বলেন, ‘কেশোটা চোর-ডাকাত হলেও ভাল ছিল। তা হলেও বুঝতাম, একটা তালেবর হয়েছে। কিন্তু এ তো বংশের নাম ডোবাল! এমন ভিতু, কাপুরুষ, এমন ব্যক্তিত্বহীন ছেলেকে যে নিজের নাতি বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করে! কাশীবাবুর বাবা নসিরাম তো আরও এক ডিগ্রি সরেস। তিনি তাঁর পুত্রের উপর এতই বিরক্ত যে, প্রাতঃকালে তার মুখদর্শন অবধি করেন না। সারাদিন কুলাঙ্গার’ বলে গালি দেন। কাশীরামের ভরসা হল, মা আর ঠাকুরমা। তাঁরা তাঁর পক্ষ নেন বটে, কিন্তু বাবা বা দাদু তাঁকে মানুষ বলেই গ্রাহ্য করেন না।