জঙ্গলের পাশেই নদী, নদীর ধারের বালির চরে বড় বড় উনুনে বিরিয়ানি আর মাংস রান্না হচ্ছে। সঙ্গে স্যালাড, পাঁপড় ভাজা, দই আর মিষ্টি। ভোজ দিচ্ছে প্রহ্লাদ। লেঠেল ললিত রান্নার তদারকি সেরে এসে কোমরের গামছায় হাত মুছে বলল, “মিটিঙে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটাই আমরা মেনে নেব বটে, তবু আমার নিজের দুটো কথা আছে, এই হাইটেক অপারেশনের যুগে কাজ করতে গেলে যে ফিটনেস এবং স্কিল দরকার, সেটা আমরা কোথায় পাব। ফরেন কোচ আমাদের স্কিল আর ছক শেখাতে পারে, কিন্তু ফিটনেস তো আলাদা ব্যাপার। তাই ফট করে বিদেশি কোচিং অ্যাডপ্ট করা ঠিক হবে না।”
কয়েকটি তরুণ কষ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ শোনা গেল। তাদের মুখপাত্র বাঘা বগলা উঠে সদর্পে বলল, “ললিতদা এখনও লাঠির মহিমা ভুলতে পারেননি। ঠিক কথা, ভূভারতে ললিতদার মতো লাঠিয়াল নেই, কিন্তু ওঁকে এখন বুঝতে হবে যে, লাঠির যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। এমনকী সনাতন বন্দুক-বোমার যুগও আর নেই। আমরা যদি এখনও খোলনলচে না পালটাই, তা হলে বারবার বিদেশি টিমের কাছে হার অনিবার্য। ফিটনেস আর স্কিল আমাদের নেই কে বলল? আসল হল প্র্যাকটিস এবং উপযুক্ত কোচিং। ঐতিহ্য আঁকড়ে পড়ে থাকার দিন শেষ। যুগের সংকেত যদি আপনারা ধরতে না পারেন, তা হলে আমাদের আরও পিছিয়ে পড়তে হবে। এই যে রাখালহরির দাপট এবং আধিপত্যকে আমরা এত ভয় পাচ্ছি, তার কারণ, রাখালহরির দলের সবাই অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণে শিক্ষিত, তাদের হাতে একেবারে হাল আমলের অটোমেটিক অস্ত্র এবং তাদের স্পিড অভাবনীয়। তাদের অ্যাটাকিং এবিলিটি যেমন সাংঘাতিক, ডিফেন্সও তেমনই মজবুত। এসব তো জাদুবিদ্যা নয়, কোচিং এবং প্রাকটিসই এর কারণ।”
সভাপতি মোটকা মল্লিক শান্তশিষ্ট মানুষ, স্বল্পভাষীও বটে, সব শুনে সে এবার বলল, “আমরা প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি, এখন যেটা আশু প্রয়োজন, সেটা হল, রাখালহরিকে নিয়ন্ত্রণ করা। সে বিষয়ে প্রহ্লাদা কিছু বলুন।”
প্রহ্লাদ নিমীলিত নয়নে বসে এতক্ষণ একটার পর একটা সুগন্ধি জরদা দেওয়া পান চিবিয়ে যাচ্ছিল। এবার পিক ফেলে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “দেখা যাচ্ছে, আমাদের ভিতরে সবাই স্পষ্ট দু’ভাগে বিভক্ত। অল্পবয়সিরা আধুনিক প্রশিক্ষণে বিশ্বাসী, বয়স্করা সনাতন কর্মপদ্ধতি বদলাতে অনিচ্ছুক। যাই হোক, আমরা কোন পন্থা নেব তা সভার শেষে ভোট নিলেই বোঝা যাবে। কিন্তু ফরেন কোচ বা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বা প্রশিক্ষণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ততদিন তো আর রাখালহরি বসে থাকবে না। তাই আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যাতে রাখালহরিকে আপাতত নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আমার প্রস্তাব আমি আগেই তোমাদের কাছে দিয়ে রেখেছি। রাখালহরির এখন তিপান্ন বছর বয়স, সে বিয়ে করেনি। সুতরাং তার ওয়ারিশন নেই। একমাত্র ওয়ারিশ তার ভাইপো ক্ষুদিরাম বা খাঁদু গড়াই। আমাদের আড়কাঠিরা খবর এনেছে, সে খয়েরগড়ের কাশীরাম রায়ের বাড়িতে এসে থানা গেড়েছে। ভাইসব, এই খাঁদু গড়াই হল রাখালহরির দুর্বল জায়গা, তার অ্যাকিলিস ছিল। কারণ, রাখালহরি তার দলের হাল ধরার জন্য খাঁদুকেই হন্যে হয়ে খুঁজছে। সে খাঁদুর হদিশ পাওয়ার আগেই খাঁদুকে আমাদের হস্তগত করা চাই। তারপর আমরা রাখালহরির উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ পাব। হিংসাত্মক পদ্ধতির বদলে কূটনৈতিক চালেই আমরা রাখালহরিকে বাগে আনতে চাই। তার ফলে তার সঙ্গে নেগোশিয়েট করার সুবিধে হবে। ভাইপোকে ফেরত পাওয়ার জন্য আমাদের শর্ত না মেনে তার উপায় থাকবে না। এ-প্রস্তাবে তোমরা রাজি থাকলে হাত ভোলো।”
প্রায় সবাই হাত তুলল। দু-একজন ঘুমোচ্ছিল বলে হাত তোলেনি।
মোটকা মল্লিক গম্ভীর গলায় বলল, “এখন জিরো আওয়ার। কারও কোনও প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। তারপর মধ্যাহ্নভোজনের জন্য সভা মুলতুবি ঘোষণা করা হবে।”
সড়কি সতীশ ছোকরা মানুষ। ইসকুলে জ্যাভেলিন থ্রো-তে খুব নাম ছিল তার। পরবর্তীকালে সে বল্লম ছোড়ায় ওস্তাদ হয়ে ওঠে। সে উঠে বলল, “আমার প্রশ্ন হল, রাখালহরির ল্যাপটপে আমাদের সব স্ট্র্যাটেজিই অ্যানালিসিস করা আছে। তার পি আর-ও দুর্দান্ত, সেক্ষেত্রে তার ভাইপোকে পণবন্দি করা কি সহজ হবে? আমার তো সন্দেহ হয়, আমাদের এই টপ সিক্রেট মিটিঙেও রাখালহরির এজেন্ট মজুত আছে। এমনও হতে পারে, সেই এজেন্ট তার মোবাইল হ্যান্ডসেটে এই মিটিঙের সব খবরই তাকে জানিয়ে দিচ্ছে।”
একথায় সভায় একটা প্রবল হইচই উঠল। বাঘা বগলা বজ্রকণ্ঠে বলল, “মিটিঙের শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছিল সবাইকে মোবাইল সুইচ অফ করে রাখতে হবে। কার মোবাইল অন আছে হাত তোলো।”
কেউ অবশ্য হাত তুলল না।
মোটকা মল্লিক মোটা গলায় বলল, “এই সাইবার পাইরেসির যুগে সবই সম্ভব। কিন্তু রিস্ক আমাদের নিতেই হবে। কারণ, রাখালহরির সঙ্গে টক্কর দিতে হলে সম্মুখসমরে পেরে ওঠা যাবে না। সে ধূর্ত এবং টেকনিক্যালি অনেক অ্যাডভান্সড। সুতরাং তার ভাইপোকে পণবন্দি করার প্রস্তাবটি অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। লাঞ্চের আগেই আমাদের কম্যান্ডো বাহিনীর নামের লিস্টি করে ফেলা দরকার। লাঞ্চের পর সভা সাইনে ডাই মুলতুবি করে দেওয়া হবে।”
ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে উঠে প্রহ্লাদ বলল, “ভাইসব, আজ এক সংকটের মুখে আমরা যে সংহতির পরিচয় দিয়েছি, সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের মূলধন। বহিরাগত শত্রু, হানাদার এবং অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে হলে এই সংহতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতা বজায় রাখতে হবে। আপনারা সকলেই যে আজ এই প্রাতঃকালীন সভায় মতানৈক্য সরিয়ে এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব উপেক্ষা করে যোগ দিতে এসেছেন, তার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি … ইত্যাদি।”