- বইয়ের নামঃ ডাকাতের ভাইপো
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. কাশীবাবু সকালে তাঁর বাগানে
ডাকাতের ভাইপো – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
কাশীবাবু সকালে তাঁর বাগানে গাছপালার পরিচর্যা করছেন। সঙ্গে তাঁর বহুকালের পুরনো মালি নরহরি। নরহরি শুধু মালিই নয়, সে বলতে গেলে অনেক কাজের কাজি। তবে সে ভারী ভিতু লোক, দুনিয়ার সব কিছুতেই তার ভয়। দিনেদুপুরে একটা গোলাপ ডালের ন্যাড়া মাথায় গোবরের টুপি পরাতে পরাতে হঠাৎ সে বলে উঠল, “হয়ে গেল! ওই এসে পড়েছে। আর উপায় নেই কর্তামশাই, সব চেঁচেপুছে নিয়ে যাবে।”
নরহরির আগড়মবাগড়মকে তেমন গুরুত্ব দেন না কাশীবাবু। কুমড়োর ভাঙা মাচাটায় বাঁধন দিতে দিতে বললেন, “কার কথা কইছিস? কে এল?”
“ওই যে দেখুন না!মুশকো চেহারা, বাঘের মতো গুল্লু গুলু চোখ, ঝাঁকড়া চুল, কোমরে নির্ঘাত ছোরাছুরি আছে।”
কাশীবাবু দেখলেন, ফটকের বাইরে একটা উটকো লোক দাঁড়িয়ে উঁকিঝুকি মারছে বটে, তবে নেহাত হাঘরে চেহারা। রোগামতো, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে একখানা চেক লুঙ্গি, গায়ে সবুজ রঙের একখানা কামিজ, কাঁধে লাল গামছা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল আছে বটে, কিন্তু চেহারা মোটেই ভয়ংকর নয়। অনেক সময় সাহায্যটাহায্য চাইতে দু’-একজন গাঁয়ে ঢুকে পড়ে, এ তাদেরই কেউ হবে হয়তো।
কাশীবাবু হাতটাত ঝেড়ে ফটকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ”কে হে বাপু তুমি? কাকে খুঁজছ?”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “বাগানখানা বড় সরেস বানিয়েছেন মশাই। কী ফলন, গাছপালার কী তেজ, দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়!”
কাশীবাবু খুশি হয়ে বললেন, “তা আর হবে না। মেহনত বড় কম করতে হয় না। গাছপালার আদরযত্ন করি বলেই না তারা ফলন্ত ফুলন্ত হয়ে ওঠে।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “বড় খাঁটি কথা মশাই। আদরযত্নটাই তো আসল কথা। আদরযত্ন না পেলে সব জিনিসই কেমন দরকচা মেরে যায়। এই আমার অবস্থাই দেখুন না। কত কী হতে পারতুম, কিন্তু হলুম একটা লবডঙ্কা। যত্নই হল না আমার।”
কাশীবাবু দয়ালু মানুষ। নরম গলায় বললেন, “আহা, যত্ন করার কেউ নেই বুঝি?”
“কে আর থাকবে বলুন! মা-মরা ছেলের জীবন বড় দুঃখের। মা মরে যাওয়ায় বাবা বিবাগী হয়ে গেলেন, জ্ঞাতিরা এসে সব বিষয় সম্পত্তি দখল করে নিল। সেই ছেলেবেলা থেকে সাতঘাটের জল খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
কাশীবাবুর চোখ ছলছল করতে লাগল। দুঃখের কথা তিনি মোটেই সইতে পারেন না। ধুতির খুঁটে চোখের কোণ মুছে ধরা গলায় বললেন, “আহা, সত্যিই তো তুমি বেশ দুঃখী লোক হে!”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে। আমাকে দুঃখের তুবড়িও বলতে পারেন। নিদেন ফুলঝুরি তো বটেই।”
উদ্বিগ্ন হয়ে কাশীবাবু বললেন, “তা হলে তোমার উপায় কী হবে বাপু?”
লোকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আজ্ঞে, উপায় তো কিছু দেখা যাচ্ছে না। খুড়োমশাইকে খুঁজে না পেলে উপায় হওয়ার জো নেই কিনা।”
নরহরি এতক্ষণ কথা কয়নি। এবার কাশীবাবুর পিছন থেকে সে খিচিয়ে উঠে বলল, “তা বাপু, গাঁয়ে খুড়ো-জ্যাঠার অভাব কী? মেলাই পাবে। যাও না, খুঁজে দ্যাখো গিয়ে।”
কাশীবাবু একবার নরহরির দিকে ভৎসনার চোখে চেয়ে ফের লোকটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “তা বাপু, তোমার খুড়োমশাই কি এই গাঁয়েই থাকেন?”
লোকটা ঠোঁট উলটে বলল, “কে জানে মশাই। থাকতেই পারেন। বাপ বিবাগী হওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘ওরে খাঁদু, তোর যে কী হবে কে জানে! যদি পারিস, তবে তোর খুড়োকে খুঁজে দেখিস। তাকে পেলে তোর একটা হিল্লে হবে।’ তা মশাই সেই থেকে খুড়োকে কিছু কম খুঁজলুম না।”
“পেলে না বুঝি?”
“একেবারে পাইনি তা বললে ভুল হবে। কখনও অর্ধেকটা, কখনও সিকিটা পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু গোটাগুটি খুড়োমশাইকে নাগালে পেলুম কই?”
“তাজ্জব কথা! খুড়োর আবার সিকি-আধুলিও হয় নাকি হে? তোমার খুড়োমশাইয়ের তো একটা ঠিকানা আছে নাকি?”
মাথা নেড়ে খাঁদু বলে, “তা তো আছেই। থাকবারই কথা। ঠিকানা না থাকার জো নেই। কিন্তু মুশকিল হল সেটা আমার বাবা আমাকে বলেননি। তাই তো গোরুখখাঁজা খুঁজতে হচ্ছে মশাই। মেহনত বড় কম যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এত মেহনতে ভগবানকে পাওয়া যায়, তো খুড়োমশাই কোন ছার!”
“ঠিকানা না থাকলেও নাম তো একটা আছে রে বাপু?”
একগাল হেসে খাঁদু বলল, “তা আর নেই! খুব আছে। দিব্যি নাম মশাই। রাখালহরি গড়াই। নবগ্রামে রাখাল গড়াইকে পেলুম বটে খুঁজে, কিন্তু তিনি কালীর দিব্যি কেটে বললেন যে, তিনি নিকষ্যি রাখাল। রাখালের সঙ্গে হরি নেই মোটেই। তারপর ধরুন, শীতলাপুরের হরিপদ গড়াই, তাঁকে পাকড়াও করতেই তিনি ভারী রেগে গিয়ে বললেন, ‘কেন হে বাপু, হরিপদ হয়ে কি আমি খারাপ আছি? আমাকে আবার একটা রাখাল গছাতে চাইছ কেন, তোমার মতলবটা কী হে?’ তারপর ধরুন, মদনপুরে খুড়োমশাইকে প্রায় পেয়েই গিয়েছিলুম। রাখালহরি গড়গড়ি। যতই বলি গড়গড়ি নয়, ওটা আসলে গড়াই, ততই তিনি গরগর করে গর্জাতে থাকেন। ঘণ্টা দুই যুঝেও তাঁকে কিছুতেই মানতে পারলুম না যে, তিনি গড়গড়ি-ও হতে পারেন এবং গড়াই কিছু খারাপ কথাও নয়।”