সদাশিব নবীনকে ভালই চেনেন। বললেন, “সে তো ভাল কথা। কিন্তু তুমি যে শুনছি গোপীনাথের কাছ থেকে বারোশো টাকা ধার নিয়েছ। এত টাকা শুধবে কী করে ভেবে দেখেছ?”
“আজ্ঞে না।”
সদাশিববাবু বাগানে ঢুকে চার দিকটা চেয়ে দেখলেন। তার পর দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “কী বাড়ি ছিল, কী হাল হয়েছে! এ যে চোখে দেখা যায় না হে নবীন।”
“যে আজ্ঞে।”
“পাতালঘরটা খুলবারও তো কোনও ব্যবস্থা হল না। হলে, কে জানে, হয়তো কিছু পেয়েও যেতে পারতে। তোমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ তো হৃদয়পুর কাছারি লুঠ করে মেলা টাকা এনেছিল। অথচ সেটা লুঠ করার কথা আমার ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ জয়শিবের।”
নবীনের একটু আঁতে লাগল। সে বলল, “আজ্ঞে, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। জয়শিব হৃদয়পুরের লেঠেলদের ভয়ে কাছারি লুঠ করার পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। আমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ কালীচরণ সাহসী পুরুষ ছিলেন। তিনি একাই উনিশজন লেঠেলকে ঘায়েল করেন। এ কথা সবাই জানে।”
সদাশিব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “তুমি কিছুই জানো না। জয়শিব আর কালীচরণ, দুজনের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। বলতে গেলে কালীচরণ ছিলেন জয়শিবের অনুগত। ডান হাত। দু’জনের একসঙ্গেই কাছারি লুঠ করতে যাওয়ার কথা। অথচ জয়শিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কালীচরণ আলাদা লোকজন নিয়ে গিয়ে আগেভাগেই কাছারি লুঠ করে সব টাকাপয়সা লুকিয়ে ফেলেন।”
“আজ্ঞে, কথাটা মোটেই ঠিক নয়। কালীচরণ কোনও দিনই কারও তাঁবেদারি করেননি। জয়শিবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি তাঁর অনুচর ছিলেন না। তাঁর বরাই আলাদা দল ছিল।”
“ইতিহাস তা বলে না রে, বাপু।”
“আজ্ঞে, তা-ই বলে। জয়শিব ভিতু ছিলেন।”
“কালীচরণ ছিলেন বিশ্বাসঘাতক।”
দু’জনের মধ্যে একটা বচসা বেধে উঠেছিল প্রায়। কিন্তু ঠিক এই সময়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে কে যেন বলে উঠল, “দুজনেই খুব খারাপ ছিল।”
সঙ্গে-সঙ্গে সদাশিব বলে উঠলেন, “জয়শিব খারাপ ছিলেন। তাঁর অনেক দানধ্যান ছিল।”
নবীনও বলে উঠল, “কালীচরণের মতো সাধু লোক কমই ছিল। ধ্যানে বসে তিন হাত ওপরে উঠে যেতে পারতেন।”
তার পর দু’জনেরই খেয়াল হল, কথাটা বলল কে আড়াল থেকে?
“নবীন, কথাটা কে বলল দ্যাখো তো! কোন বেয়াদব?”
ঝোপের আড়াল থেকে সাহেবি পোশাক পরা একটা লোক বেরিয়ে এসে বলল, “আমি বলেছিলাম।”
সদাশিব লোকটার দিকে বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি! তা তুমি এখানে উদয় হলে কী করে?”
অভিজিৎ মৃদু হেসে বলল, “চারদিকটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিলাম। এখানে তো পোকামাকড়ের অভাব নেই। এই জঙ্গলটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি।”
“আড়াল থেকে অন্যের কথা শোনাটা ভাল কাজ নয়।”
অভিজিৎ জিভ কেটে বলল, “ইচ্ছে করে শুনিনি। একটা ক্যাটারপিলার দেখতে পেয়ে সেটাকে একটু অবজার্ভ করছিলাম। কানে আপনাদের কথা আসছিল। শুনে মনে হল, আপনাদের দু’জনেরই পূর্বপুরুষরা ডাকাত ছিলেন।”
“ছিলেন তো কী! সে-আমলে ডাকাতদেরও ইজ্জত ছিল। জয়শিবকে ব্রিটিশ সরকার ‘রায়সাহেব’ উপাধি দিতে চেয়েছিল তা জানো?”
নবীনও বলে উঠল, “আর কালীচরণকে সোনার মেডেল।”
অভিজিৎ হাত তুলে বলল, “ঘাট হয়েছে। আপনাদের দু’জন পাছে ঝগড়া পাকিয়ে তোলেন, তাই আড়াল থেকে কথাটা বলে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না। আচ্ছা, আপনিই তো নবীনবাবু?”
নবীন বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“আপনার এই বাড়িটা ভারী অদ্ভুত। বাগানে পোকা-মাকড় খুঁজতে-খুঁজতে আমি জঙ্গলটায় কয়েকটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি।”
“কী বলুন তো?”
“ওই দক্ষিণের দিকে ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে একটা ঢাকনা দেওয়া কুয়ো আছে। ওটা কিসের বলুন তো?”
নবীন বেজার মুখে বলল, “কুয়ো আর কিসের হবে। জলের।”
সদাশিব অট্টহাসি হেসে বললেন, “জলের না হাতি! ওর ঠ্যাঙাড়ে পূর্বপুরুষেরা মানুষ মেরে ওই কুয়োয় লাশ ফেলত। খুঁজলে ওর মধ্যে বিস্তর কঙ্কাল পাওয়া যাবে।”
সদাশিব উঠে পড়লেন, “চলল হে অভিজিৎ।”
নবীন বেজার মুখ করে ফোয়ারার ধারে বসে রইল। বসে পূর্বপুরুষদের কথা ভাবতে লাগল।
৪. ভুজঙ্গ গাড়িটা রাস্তার ধারে
ভুজঙ্গ গাড়িটা রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে বলল, “এই সেরেছে!”
পিছন থেকে অনু অর্থাৎ অনন্যা বলল, “কী হয়েছে ভুজঙ্গদা?”
“গাড়িটা গড়বড় করছে গো দিদিভাই। এতটা পথ দিব্যি চলে এলাম। আর মোটে মাইল চারেক পথ বাকি। একেবারে তীরে এসে তরী ডুবল রে ভাই।”
ভুজঙ্গ নেমে বনেট খুলে খুটখাট করতে লাগল। বিলু অর্থাৎ বিশিব দিব্যি ঘুমোচ্ছিল গুটিসুটি মেরে শুয়ে। দুই ভাই-বোন পালা করে ঘুমোনোর কথা। কিছুক্ষণ অনু ঘুমিয়েছে, এবার বিলু।
অনু ডাকল, “এইবিলু, ওঠ ওঠ।”
বিলু ধড়মড় করে উঠে পড়ে বলল, “এসে গেছি! ওফ, আমার যা খিদে পেয়েছে না। ঠাকুমা নিশ্চয় ডালপুরি করেছে। গন্ধ পাচ্ছি।”
অনু হেসে বলল, “খুব তোর নাক! চার মাইল দূর থেকে ডালপুরির গন্ধ পাচ্ছিস?”
“চার মাইল!”
“গাড়ি খারাপ। আমাদের হয়তো হেঁটে যেতে হবে।”
শীতকাল বলে সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামছে। এর মধ্যেই আলো সরে চার দিকটা গাঢ় কুয়াশায় ঢেকে গেছে। দু ধারে জঙ্গল। লোকবসতি বিশেষ নেই।
বিলু নেমে গিয়ে ভূজঙ্গের পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির মেরামতি দেখতে লাগল।
“কী হয়েছে গো ভুজঙ্গদা?”
“ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে, তেলে ময়লা আসছে, ব্যাটারিও যেন মনে হচ্ছে ডাউন। বরাতটাই খারাপ দেখছি। একসঙ্গে এতগুলো গণ্ডগোল তো সহজে হয় না।”