গোপীনাথ কটমট করে নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “কত চান বলুন তো?”
মাথা চুলকে নবীন একটু ভাবল। লোককে খাওয়াতে সে খুবই ভালবাসে। দ্বাদশ ব্রাহ্মণের সঙ্গে যদি আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এবং পাড়া-প্রতিবেশীকে খাইয়ে দেওয়া যায়, তা হলে মন্দ কী!
“আজ্ঞে, দ্বাদশ ব্রাহ্মণের জন্য দ্বাদশ শত অর্থাৎ কিনা বারোশো টাকা হলেই চলবে।”
গোপীনাথ এত অবাক হল যে, প্রথমটায়, মুখে বাক্য সরল না। তার পর বলল, “আপনি জানেন যে, আমার নিজের এক দিনের খোরাকি মাত্র বারো টাকা?”
“বড়লোকদের একটু কমই লাগে। তাদের খিদেও কম, খাওয়াও কম। কিন্তু গরিবদের তো তা নয়। তারা কষি খুলে, প্রাণ হাতে নিয়ে খায়। একেবারে হাঘরের মতো। একটু বেশি তো লাগবেই।”
গোপীনাথ বিজ্ঞের মতো বলল, “আপনাকে যে টাকা দিতে রাজি হয়েছি, এই ঢের জানবেন। কুল্যে পঞ্চাশটা টাকা দিচ্ছি, ওইতেই বামুনদের চিড়ে-দই ফলার করান তো।”
নবীন ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তার চেয়ে পিসি বরং নরকেই যাক গোপীবাবু। বামুন না-খাওয়ালে মেয়াদ কিছু কম হতে পারে। পিসির পাপ-টাপও বেশি নেই, সহজে উদ্ধার হয়ে যাবে। আর ফলার খাওয়ালে? বারোটা বামুনের অভিশাপ ঘাড়ের ওপর গদাম গদাম করে এসে পড়লে, নরকের যমদূতেরা পিসির গায়ে কাঁকড়া বিছেও ছেড়ে দেবে।”
গোপীনাথ একটু শিউরে উঠল, “তারা ব্রহ্মময়ী! দেখো মা। যাক গে, বারোশো টাকার সুদ গুনতে পারবেন তো? বড় কম হবে না।”
“যে আজ্ঞে।”
“আর শুনুন, ফের সাবধান করে দিচ্ছি, ওই পাতালঘরের ধারেকাছে কিন্তু আর যাবেন না। বাড়ি, বলতে গেলে, এখন আমারই। কোনও রকম ভাঙচুর হলে কিন্তু মুশকিলে পড়বেন। মনে থাকে যেন।”
“যে আজ্ঞে।”
খাজাঞ্চিকে ডাকিয়ে হ্যান্ডনোট লেখানোর পর নবীনকে টাকা দিয়ে দিল গোপীনাথ। আচ্ছা চশমখোর লোক। বারোশো টাকার এক মাসের সুদও ধরা হয়েছে বারোশো টাকাই। শোধ দিতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণ বেড়ে যাবে।
তবে নবীন বড় একটা ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবে না। তার চিন্তা বর্তমানকে নিয়ে। সে টাকা নিয়ে বাড়ি এসে সোল্লাসে বলে উঠল, “পিসি, আর ভয় নেই। যমদূতেরা আর তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। বারোটা বামুনের খাওয়ার জোগাড় করো।”
পিসি আহ্লাদে চোখের জল ফেলতে লাগল। বলল, “আমি যদি স্বর্গে যাই, তোকেও টেনে নেব বাপ, দেখিস। সেখানে ভারী ভাল ব্যবস্থা।”
“সেখানে কী রকম ব্যবস্থা গো পিসি?”
“সকালে উঠলেই দুধের সর দিয়ে খইয়ের মোয়া। বুঝলি? তার পর দুপুরে পোলোয়া তো রোজই হয়। অ্যাই বড় বড় চিতল মাছের পেটি খাবি। তার পর বিকেলে গাওয়া ঘিয়ের লুচি। রাতে মাংস, পায়েস, কত কী!”
“আর কী?”
“ও রে, স্বর্গে কি কিছুর অভাব! সেখানে শীতকালে ল্যাংড়া আম, গ্রিষ্মিকালে কমলালেবু। চালে কাঁকর নেই। আরও একটা ভাল জিনিস হল, স্বর্গে নাকি একাদশী করতে হয় না।”
“তা হলে তো দারুণ জায়গা পিসি।”
পিসি ফোকলা মুখে হেসে বলল, “তবে?”
পিসির বামুন আর নবীনের বন্ধু-বান্ধব মিলে বড় কম হবে না। বিরাট আয়োজন করতে হবে। বহু দিন বাদে নবীনের মনে বড় স্ফুর্তি এল। সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাগানে বেড়াতে গেল।
নবীনের বাগানটারও কোনও ছিরিছাঁদ নেই। দেখাশোনা করা হয় না বলে আগাছায় ভরে গেছে। তারই মধ্যে স্থলপদ্ম বা গোলাপও যে ফোটে না এমন নয়। তবে বাগানের চেয়ে জঙ্গল বললেই ঠিক বলা হয়।
বাগানে এক সময়ে পাথরের পরী, ফোয়ারা এসব ছিল। পরী বহু কাল আগে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে, তাকে আর তোলা হয়নি। ফোয়ারা বহু কাল বন্ধ।
ফোয়ারার ধারটা এক সময়ে চমৎকার বাঁধানো ছিল। বাড়ির লোকেরা তার ধারে বসে বিকেল কাটাত। এখনও নবীন এসে ফোয়ারার ধারেই বসে।
আজও নবীন ফোয়ারার ধারে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। কত কী যে সে ভাবে। ভোজটা হয়ে গেলে হাতে যা টাকা থাকবে, তাই দিয়ে সে একবার হরিদ্বার ঘুরে আসবে। সে বার হৃষিকেশের এক সাধু তাকে একটা স্ফটিকের মালা দেবে বলেছিল। বেজায় সস্তা। মাত্র দেড়শো টাকা দাম। সাধুকে খুঁজে পেলে মালাটা কিনে ফেলবে। আরও কত কী করবে সে… শুধু পাতালঘরটা যদি একবার খুলতে পারত!
দাদু কি সত্যিই পাতালঘর খোলার হদিস পেয়েছিল? কীভাবে পেয়েছিল?
কাছেই কে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নবীন চমকে উঠে চেয়ে দেখল, কেউ কোথাও নেই।
একটু নড়েচড়ে বসল সে। হঠাৎ ফটকের ও পাশ থেকে কে যেন হাঁক দিয়ে তাকে ডাকল, “নবীন! বলি ও নবীন! বাড়ি আছ নাকি?”
নবীন গিয়ে দ্যাখে, সদাশিববাবু।
“আজ্ঞে আসুন। গরিবের বাড়ি অনেক দিন পায়ের ধুলো দেননি।”
সদাশিববাবু নবীনের দিকে চেয়ে বললেন, “কী সব শুনছি বলো তো?”
“আজ্ঞে?”
“তুমি নাকি ফের টাকা ধার করেছ?”
নবীন লজ্জিতভাবে মাথা চুলকোতে লাগল। এই সদাশিববাবুর পূর্বপুরুষদের সঙ্গে নবীনের পূর্বপুরুষদের সাঙ্ঘাতিক শত্রুতা ছিল এক সময়ে। এ-ওকে পেলে ছিঁড়ে ফেলে আর কি। দু’ পক্ষের লোকজনের হাতে পারস্পরিক খুন-জখম লেগেই থাকত। বড় ঝিলে যে কত লাশ ফেলা হত, তার হিসেব নেই। নবীনের ঠাকুরদার আমলেও সেই রেষারেষি ছিল। এই আমলে আর নেই। নবীনের অবস্থা খুবই পড়ে গেছে, সদাশিববাবুর অবস্থা সেই তুলনায় যথেষ্ট ভাল। রেষারেষি হয় সমানে-সমানে।
নবীন বলল, “আজ্ঞে, পিসি কী একটা ব্রত করেছে। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ না খাওয়ালেই নয়।”“।