মহাদেব গম্ভীর মুখে বলল, “সেটা আমারও মনে হয়, তোমার ঠাকুরদাও সারাটা জীবন ওই পাতালঘরে সেঁধোবার চেষ্টা করেছেন। শাবল-গাঁইতিও কিছু কম চালানো হয়নি। শেষে একেবারে শেষ জীবনে তিনি চুপচাপ পাতালঘরের সামনে বসে থাকতেন। তার পর যখন মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন, তখন আমি তাঁর কাছেই দিন রাত মোতায়েন থাকতাম। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে হঠাৎ তোমার ঠাকুদা চোখ মেলে চাইলেন। মুখখানা ভারী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। আমার দিকে চেয়ে বললেন, “পেয়েছি রে, পেয়েছি।”
নবীন সাগ্রহে বলল, “তার পর?” মহাদেব মাথাটা হতাশায় নেড়ে বলল, “কী পেয়েছেন, সেইটে আর বলতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলাম, উনি শুধু বললেন, “পাতালঘর। তার পরই নেতিয়ে পড়লেন, চোখ উল্টে গেল, জিভ বেরিয়ে পড়ল। মরে গেলেন।”
“ইশ, অল্পের জন্য হল না তা হলে?”
“খুবই অল্পের জন্য। আমার মনে সেই থেকে বিশ্বাস, তুমি যে-রকম ভাবে দেওয়াল বা দরজা ভাঙাভাঙির চেষ্টা করে যাচ্ছ, সেভাবে হবে না।”
“তবে কীভাবে হবে? মহাজনের হাতে বাড়ি চলে যেতে তো আর দেরি নেই, মহাদেবদা।”
“সবই তো বুঝি নবীনভায়া, কিন্তু আমার বুড়ো মাথায় তো কোনও কিছুই খেলছে না, আমিও কি কিছু কম ভেবেছি!”
নবীন চিন্তান্বিত হয়ে বলল, “পাতালঘরে ঢোকা ছাড়া যে আর পথ দেখছি না মহাদেবদা। পিসি বারোজন বামুন খাওয়াবে, তা তারও পয়সা হাতে নেই। এ রকম করে চললে যে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।”
মহাদেব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “দ্যাখো নবীনভায়া, ওটা পুরুষ-মানুষের মতো কথা নয়। তোমার বংশ ডাকাতের বংশ। তার একটা খারাপ দিক আছে বটে, আবার একটা ভাল দিকও আছে। তোমার বংশের লোকের বুকের পাটা ছিল। তারা ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যেত না। তোমাকেও সেই রকম হতে হবে। সাহসী হও, দুনিয়াটা দুর্বলদের জায়গা নয়।”
নবীন মুখখানা হাঁড়ি করে বসে রইল।
আংটি ছিল, মায়ের গয়না ছিল, পুরনো কিছু মোহর ছিল। সবই গেছে। এখন এই বসত-বাড়িটা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। দিন আর চলে না। কোনও বন্দোবস্ত না হলে বুড়ি পিসি আর বুড়ো মহাদেবদাকে নিয়ে গিয়ে গাছতলায় দাঁড়াতে হবে।
বিকেলের দিকে নবীন গিয়ে গোপীনাথ মহাজনের কাছে হাজির হল।
গোপীনাথের কারবার অনেক। নানা রকমের ব্যবসা তার। তার মধ্যে একটা হল, চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া আর বন্ধক রাখা। কেটেরহাটে তার মতো ধনী আর প্রতাপশালী লোক কমই আছে এখন। তার হাতে মেলা লোকজন। হাতে মাথা কাটতে পারে।
গোপীনাথের চেহারাখানাও পেল্লায়। থলথলে ভুড়িদার
চেহারা নয়, রীতিমতো পালোয়নের স্বাস্থ্য। চোখ দু’ খানা সাঙ্ঘাতিক কুটিল। চোখের দিকে তাকালে যে-কোনও লোকেরই বুকটা গুড়গুড় করে উঠবে।
নবীন যখন তার সামনে গিয়ে হাজির হল, তখন গোপীনাথ তার বৈঠকখানায় বসে বাদামের শরবত খাচ্ছে আর নিজের পোষা ব্লাডহাউণ্ড কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে।
নবীনকে দেখে গোপীনাথ একটু বিরক্তির গলায় বলল, “কী খবর নবীনবাবু?”
নবীন কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “আপনার কাছে আজ আমার একটা প্রার্থনা আছে। এই শেষবার।”
গোপীনাথ বোধহয় এই সব বনেদি পড়তি বড়লোকের ছেলেদের বিশেষ পছন্দ করে না। শরবতের গেলাসটা ধীরেসুস্থে শেষ করে পাশের টেবিলে রেখে বলল, “পুরনো বাড়ি বাঁধা রেখে আপনাকে যা টাকা দিয়েছি, তাও আমার উশুল হবে না। যদি আর টাকা চান, তা হলে আগেই বলি, এক পয়সাও দিতে পারব না।”
নবীন মৃদুস্বরে বলল, “কিন্তু আমার পিসিকে যমদূতেরা নাকি গরম সাঁড়াশি দিয়ে ছিড়বে, কয়েক হাজার বছর ধরে সেদ্ধ করবে, রোদে শুকিয়ে হেঁটমুণ্ড করে রাখবে। তার পর আবার কাঁটার বিছানায় শোওয়াবে…ওফ…সে ভাবা যায় না…”
গোপীনাথ চোখ গোল করে এ সব শুনল, তার পর বলল, “বটে? তা পিসিকে এত সব খবর কে দিল?”
নবীন অম্লান বদনে বানিয়ে বলল, “আজ্ঞে কয়েক দিন আগে এক মস্ত তান্ত্রিক এসেছিলেন বাড়িতে। যদুপুরের অঘোরবাবা, নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন, সাক্ষাৎ পিশাচসিদ্ধ। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে অনবরত যাতায়াত করেন। তিনি নরকের একেবারে হালের খবর এনে দিয়েছেন।”
গোপীনাথের মুখটা কেমন যেন পাঁশুটে মেরে গেল। চাকরকে ডেকে কুকুরটাকে নিয়ে যেতে বলে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল গোপীনাথ। তার পর বলল, “যদিও আমি ও সব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করি না, ‘অঘোরবাবা’ বলে কারও নামও আমি শুনিনি, তবে নরকের ব্যাপারটা যেন কে আমাকে বলেছিল বটে।”
“আজ্ঞে, কী বলেছিল?”
“আরও খারাপ। দু পায়ে দুই তেজী ঘোড়াকে বেঁধে দু ধারে ছুটিয়ে দেওয়া হয়। ফলে একেবারে মাঝখান দিয়ে চিরে দু ফালা হয়ে যায় লোকে।”
“আজ্ঞে, নতুন নতুন গ্যাজেট তো নরকেও বেরোচ্ছে। হয়তো গায়ে জোঁক ছেড়ে দেয়, শুয়োপোকা ছেড়ে দেয়…”
“ও বাবা!”
গোপীনাথ নিমীলিত নয়নে কিছুক্ষণ নরকের দৃশ্যটাই বোধহয় কল্পনার চোখে প্রত্যক্ষ করে নিল। তার পর হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবল কণ্ঠে বলে উঠল, “তারা ব্রহ্মময়ী, তুমিই ভরসা। সব সামাল দিও মা…”
নবীন মৃদু হেসে বলল, “আজ্ঞে শুনেছি, গরিব ব্রাহ্মণকে সাহায্য করলে নাকি যমদূতেরা আর ততটা অত্যাচার করে না। ধরুন, সাঁড়াশিটা হয়তো তেমন গরম করল না, সেদ্ধটা ভাল রকম হওয়ার আগেই তুলে ফেলল, কিংবা নুন মাখানোর বদলে পাউডার মাখাল…”