সিদ্ধিনাথ মাথা চুলকে বলল, “কতাবাবু, আপনার তো দয়ার শরীর, সারা জীবন পাপ-তাপ কিছু করেননি, বুড়ো বয়সে কি শেষে নরহত্যার পাপে পড়বেন?”
সদাশিব হাঁ করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তার পর বললেন, “বটে! নরহত্যার পাপ? সেটা কী করে আমার ঘাড়ে অশাবে রে ধর্মপুর?”
সিদ্ধিনাথ যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে, ভাল মানুষের ছেলেদের যে সব ঝিলের বাড়িতে থাকতে দিলেন, ওদের অপঘাত তো ঠেকানো যাবে না। বাড়ির পড়ো-পড়ো অবস্থা। দেওয়াল-চাপা পড়ে সবগুলো মরবে যে!”
“তাতে আমার পাপ হবে কেন রে গো-মুখ? ওরা তো দেখে-শুনেই ও বাড়িতে থাকতে চাইছে। মরলে নিজেদের দোষে মরবে।
“তা না হয় হল, কিন্তু আমাকেও যে বিদেয় করতে চাইছে। বলছে দেশে যাও, না হয় তীর্থ করে এসো।”
“সে তো ভাল কথাই বলছে। যা না।”
সিদ্ধিনাথ বেজার মুখ করে বলল, “আপনি তো বলেই খালাস। কিন্তু আমি, কেটেরহাট ছাড়া অন্য জায়গায় গিয়ে কি বাঁচব?”
সদাশিব চোখ মিটমিট করে সিদ্ধিনাথের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “তোর বয়স কত হল, তা জানিস?”
“আজ্ঞে না।”
“তুই আমার চেয়েও অন্তত দশ-পনেরো বছরের বড়।”
“তা হবে। আপনাকে এইটুকু দেখেছি।”
“হিসেব করলে তোর যা বয়স দাঁড়ায়, তাতে তোর দু বার মরার কথা।”
“তা বটে।”
“অথচ তুই একবারও মরিসনি।”
“তা বটে।”
“তা হলে কেটেরহাটের বাইরে গিয়ে যদি না বাঁচিস, তা হলেই বা দুঃখ কী?”
৩. নবীন খেতে ভালবাসে
নবীন নিজে যেমন খেতে ভালবাসে, তেমনই লোকজনকে ডেকে খাওয়াতেও ভালবাসে। কিন্তু তার এখন যা অবস্থা, তাতে নিজেদেরই ভাল করে জোটে না, লোককে ডেকে খাওয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।
তবে বুড়ি পিসি কী একটা ব্রত করেছে, তাতে নাকি দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন না করালেই নয়। ক’ দিন ধরেই পিসি ঘ্যানঘ্যান করছে, নবীন কথাটা তেমন কানে তোলেনি।
কিন্তু আজ এসে পিসি ধরে পড়ল, “ও বাবা নবীন, তুই কি শেষে আমাকে চিরটা কাল নরক ভোগ করতে বলিস? নরক যে সাঙ্ঘাতিক জায়গা বাবা, যমদূতেরা বড়-বড় সাঁড়াশি লাল টকটকে। করে গরম করে নিয়ে, তার পর তাই দিয়ে নাক কান হাত-পা সব টেনে-টেনে হেঁড়ে। তার পর হাঁড়ির মধ্যে গরম জলে ফেলে সেদ্ধ করতে থাকে। সেও শুনি হাজার হাজার বছর ধরে সেদ্ধ করতেই থাকে। মাঝে-মাঝে হাতা দিয়ে তুলে দেখে নেয়, ঠিক মতো সেদ্ধ হয়েছে কি না, আর তাতেই কি রেহাই আছে বাপ? সেদ্ধ হলে পর নাকি সর্বাঙ্গে নুন মাখিয়ে রোদে শুকোয়, তার পর হেঁটমুণ্ডু করে-করে ঝুলিয়ে রাখে, তার পর কাঁটার বিছানায় শুইয়ে রাখে, তার পর…”
নবীন মাথা নেড়ে-নেড়ে শুনছিল; বলল, “তার পর আর বাকি থাকে কী পিসি? এত কিছুর পর কি আর কেউ বেঁচে থাকে?”
পিসি মুখখানা তোম্বা করে বলল, “বাছা রে, একবার মরলে পরে আর যে মরণ নেই। নরকের ব্যবস্থাই তো ও রকম। যতই যা করুক না কেন, আর মরণ হবে না যে! তার পর সেখানে এঁটোকাঁটার বিচার নেই, চার দিকে নোংরা আবর্জনা আঁস্তাকুড়। একটু ভেবে দ্যাখ বাপ, মাত্র বারোটা বামুন খাওয়ালে যদি ফাঁড়াটা কাটে, তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।”
নবীন ম্লান মুখে বলল, “আচ্ছা পিসি, দেখছি কী করা যায়।”
পিসি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল। জানে, নবীনের মনটা বড় ভাল। ঠিকই ব্যবস্থা করবে।
নবীন দুপুরবেলা একতলায় নেমে এল। নাচঘরের দক্ষিণ-কোণে দেওয়ালের মধ্যে একটা ছোট্ট ছিদ্র। তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা হাতল ঘোরালেই মেঝেতে একটা সিঁড়ির মুখ খুলে যায়। সরু সিঁড়ি, অন্ধকারও বটে।
সিঁড়ি দিয়ে টর্চ হাতে নবীন নেমে এল মাটির নীচে। চার দিকে একটা টানা গলি, মাঝখানে নিরেট পাতালঘর। পাথরের দেওয়াল, লোহার দরজা, নবীন অন্তত হাজারবার এই পাতালঘরে হানা দিয়েছে। দেওয়ালে বা দরজায় শাবল বা হাতুড়ি মারলে ফাঁপা শব্দও হয় না। এতই নিরেট।
নবীনের হাতে এখন একেবারেই টাকাপয়সা নেই। কারও কাছে হাত পেতেও লাভ নেই। কেউ দেবে না। সকলেই জানে যে, নবীনের অবস্থা খারাপ, তার বিষয়-সম্পত্তি মহাজনের কাছে বাঁধা। ধার নিলে নবীন শোধ করতে পারবে না।
নবীন পাতালঘরের দরজার সামনে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। কী করা যায়?
নবীন বসে-বসে ভাবতে লাগল। ভাবতে-ভাবতে তার একটু ঢুলুনিও এসে গেল। ঢুলতে-দুলতে তার মাথার মধ্যে নানা চিন্তা হিজিবিজি ঘুরে বেড়াতে লাগল। মহাজন টের পাওয়ার আগেই গোপনে লোক লাগিয়ে পাতালঘরের দেওয়াল যদি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়। অবশ্য তা হলে বাড়িটাও ধসে পড়তে পারে। যদি সুড়ঙ্গ কেটে ঢোকা যায়? যদি…
হঠাৎ তার কানে কে যেন মৃদু স্বরে বলে উঠল, “দূর বোকা! ওভাবে নয়।”
নবীন চমকে সোজা হয়ে বসে বলল, “কে?”
না, কেউ কোথাও নেই।
নবীন চার ধারটা খুব ভাল করে খুঁজে দেখল। কারও দেখা পেল না। পাতালে নামবার দরজাটা যেমন বন্ধ ছিল, তেমনই আছে।
খুবই চিন্তিতভাবে ওপরে উঠে এল। তার পর মহাদেবকে ডেকে বলল, “দ্যাখো মহাদেবদা, তুমি বহু পুরনো আমলের লোক। আজ যে ঘটনাটা ঘটল, তার মানেটা কী আমাকে বুঝিয়ে দেবে?”
মহাদেব খুব গম্ভীর মুখ করে ঘটনাটা শুনল, পাকা মাথাটি নেড়ে মাঝে-মাঝে ‘হু’ দিল। তার পর অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, “না গো নবীনভায়া, ঠিক বুঝতে পারছি না।”
নবীন খুব আগ্রহের সঙ্গে বলল, “কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, পাতালঘরে ঢোকার একটা সহজ পথ আছে।”