সিদ্ধিনাথ মুখখানা বিকৃত করে বলল, “ভূতের কথা আর বলিস। তাদের আক্কেল দেখলে ঘেন্না হয়। এমনিতে তেনারা রোজ বাড়ির মধ্যে ভূতের নেত্য, ভূতের কেত্তন লাগাবেন, কিন্তু যখনই শহরের বাবুভায়েরা এল, অমনি সব নতুন বউয়ের মতো চুপ মেরে যান। এই তো কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে কাবাবুর ছেলের বন্ধুরা সব বেড়াতে এল। বউ-বাচ্চা সব নিয়ে। বনভোজন করল, কানামাছি খেলল। দু-তিন রাত্রি দিব্যি কাটিয়ে দিল। তা কই, তেনারা তো রা’ও কাড়েননি।”
শ্রীপতি একটু ভেবে বলল, “আসলে কি জানো সিদ্ধিনাথদা, গেঁয়ো ভূত তো, শহুরে লোককে ভয় দেখাতে ঠিক সাহস পায় না।”
সিদ্ধিনাথ উঠল, “যাই রে, কাবাবুর কাছে যেতে হবে।”
বাজারের মুখে পীতাম্বরের দরজির দোকানেও খানিক বসল সিদ্ধিনাথ। গায়ের পিরানটার বোতাম নেই। সেটা খুলে দিয়ে বলল, “দুটো বোতাম বসিয়ে দে বাবা।…বৃত্তান্তটা শুনেছিস? ঝিলের বাড়িতে যে সব কলকাতার বাবুরা এসে গেল।”
পীতাম্বর বোম বসাতে বসাতে বলল, “বুঝবে ঠেলা।” সিদ্ধিনাথ উদাস মুখে বলল, “মেলা টাকা। জিনিসপত্রও তো দেখছি পাহাড়প্রমাণ। কী মতলব কে জানে বাবা।”
পীতাম্বর দাঁতে সুতো কেটে বলল, “তোমার ঝিলের তলার সেই মন্দিরের হদিস পায়নি তো?”
সিদ্ধিনাথ একটু চমকে উঠে বলল, “ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস তো! নাঃ, এ তো বেশ ভাবনার কথা হল।”
পীতাম্বর নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “ভাববার কী আছে? তুমি চল্লিশ বছর ধরে চেষ্টা করে যার হদিস করতে পারোনি, বাবুরা কি
আর হুট করে তার খোঁজ পাবে?”
“তা বটে। পাপী-তাপীদের কম্মও নয়। তবে কিনা এ হল ঘোর কলিকাল। উলট-পুরাণ যাকে বলে।”
পিরান গায়ে দিয়ে সিদ্ধিনাথ উঠে পড়ল।
পথে নবীনের বাড়ি। নবীন লোকটার জন্য সিদ্ধিনাথের ভারী দুঃখ হয়। সদাশিব কতার মতো নবীনের পূর্বপুরুষেরাও ডাকাত ছিল। শোনা যায়, তাদেরই দাপট ছিল বেশি। অবস্থা ছিল রাজা-জমিদারের মতোই। সেই নবীনের আজ টিকি অবধি মহাজনের কাছে বাঁধা।
অথচ নবীন লোকটা বড় ভাল। দোষের মধ্যে বেড়ানোর নেশা আছে, লোককে খাওয়াতে ভালবাসে, আর উদ্ভট জিনিস দেখলেই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে কিনে ফেলে। এই সব করে করে হাতের টাকা সব চলে গেছে। বাড়িটা অবধি মহাজনের কাছে বিক্রি করালায় বাঁধা।
থাকার মধ্যে নবীনের আছে এক বুড়ি পিসি আর এক পুরনো চাকর মহাদেব। প্রকাণ্ড দোতলা বাড়িটাতে তিনটে মোটে প্রাণী।
বয়সে নিতান্ত ছোঁকরা বলে সিদ্ধিনাথ নবীনকে নাম ধরেই ডাকে।
ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে সিদ্ধিনাথ হাঁক দিল, “ও নবীন! বলি নবীন আছ নাকি হে?”
নবীন দোতলার বারান্দায় বসে বই পড়ছিল। মুখ বাড়িয়ে বলল, “কী ব্যাপার সিদ্ধিনাথ-খুড়ো।”
“আর ব্যাপারের কথা বলল না। বলি কেটেরহাট যে কলকাতা হয়ে গেল হে। ঝিলের ধারের বাড়িতে যে ভাড়াটে এসেছে, সে-খবর রাখো?”
“সে তো ভাল কথা খুড়ো। তুমি এত কাল একা ছিলে, এবার কথা বলার লোক হল।”
“হ্যাঁ, কথা বলতে তাদের বড় বয়েই গেছে। আমাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। এক বার বলছে ‘দেশে যাও’, আবার বলছে ‘তীর্থ করে এসো গে’। মতলব বুঝে উঠতে পারছি না। পয়সা দিতে চাইছে।”
“দাঁওটা ছেড়ো না খুড়ো। এই বেলা ঘুরে-টুরে এসো গে।”
“ওরে বাপ রে, সে কি আর ভাবিনি? তবে কিনা কেটেরহাটের হাওয়া ছাড়া আমি যে হাঁফিয়ে উঠব বাপ।”
“তা বটে। তুমি হলে কেটেরহাট-মনুমেন্ট।”
“তোমার খবর-টবর কী? পাতাল-ঘরের দরজা খুলতে পারলে?”
নবীন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “না খুড়ো। বিশ বছরের চেষ্টাতেও খুলল না। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।”
সিদ্ধিনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নবীনের কপালটা সত্যিই খারাপ। বাড়ির তলায় একখানা পাতাল-ঘর আছে। কিন্তু মুশকিল হল, সেটার দরজা ভীষণ পুরু আর শক্ত, লোহার পাতে তৈরি। তাতে না আছে কোনও জোড়, না আছে চাবির ফুটো। কীভাবে সেই দরজা খুলবে, তা কে জানে। হাতুড়ি শাবল দিয়ে বিস্তর চেষ্টা করা হয়েছে, দরজায় আঁচড়ও বসেনি। দেওয়াল ফুটো করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু নিরেট পাথরের দেওয়াল টলেনি। কে জানে, হয়তো ওই পাতালঘরে গুপ্তধন থাকতেও পারে।
পাতালঘরের কথা মহাজন গোপীনাথ জানতে পেরে নবীনকে শাসিয়ে গেছে, “খবরদার, ও ঘরে হাত দেওয়া চলবে না। বাড়ি আমার কাছে বাঁধা, তার মানে বাড়ি এক রকম আমারই। এখন বাড়ির কোনও রকম চোট-টোট হলে কিন্তু জবাবদিহি করতে হবে।”
গোপীনাথ শুধু মহাজনই নয়, লেঠেলদেরও সর্দার। তার হাতে মেলা পোষা গুণ্ডা-বদমাশ আছে। কাজেই তাকে চটিয়ে দিলে সমূহ বিপদ। নবীন তাই ভারী নির্জীব হয়ে আছে, আজকাল।
“তোমার কপালটাই খারাপ হে, নবীন। পাতালঘরটা খুলতে পারলে বুঝি বরাত ফিরে যেত।”
নবীন একটা হতাশার ভঙ্গি করে বলল, “পাতালঘরের কথা বাদ দাও, খুড়ো, তোমার ঝিলের তলার মন্দিরের কী হল বলো!”
সিদ্ধিনাথ কপাল চাপড়ে বলল, “আমার কপালটাও তোমার মতোই খারাপ হে, নবীন।”
সিদ্ধিনাথ নবীনের কথাটা ভাবতে ভাবতে ফের এগোল।
পথে আরও নানা চেনা লোক, চেনা দোকান, চেনা বাড়ি। সকলের সঙ্গে একটা-দুটো করে কথা বলতে বলতে যখন সদাশিবের বাড়ি গিয়ে হাজির হল, তখন প্রায় দুপুর, সদাশিব স্নানের আগে রোদে বসে তেল মাখছেন।
সিদ্ধিনাথ কাঁচুমাচু মুখ করে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সদাশিব মুখ তুলে চেয়ে বললেন, “এই যে নবাবপুর, এত দিনে দেখা করার সময় হল? বলি, সারা দিন কী রাজকার্য নিয়ে থাকা হয় শুনি? ঝিলের..তলার মন্দির নিয়ে ভেবে-ভেবে বাবুর বুঝি ঘুম হচ্ছে না?”