সিদ্ধিনাথ আবার এসে পৈঠায় বসতে যেতেই ফটকের বাইরে একটা গাড়ির ভ্যাঁপোর ভোঁ শোনা গেল। বেশ ঘন-ঘন শব্দ হচ্ছে। কে যেন চেঁচাচ্ছে, “সিদ্ধিনাথ! ওহে সিদ্ধিনাথ!”
সিদ্ধিনাথ ভারী অবাক হল। কে আবার এল জ্বালাতে?
বাড়িটা ঘুরে সামনের দিকে বাগান পার হয়ে ফটকের কাছে এসে সিদ্ধিনাথ দেখল, জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে। কয়েকজন বাবু গেট ধরে ঝাঁকঝাঁকি করছেন।
“কী চাই আপনাদের?”
“আপনিই কি সিদ্ধিনাথ?”
“হ্যাঁ, আপনারা কারা?”
“আমরা সদাশিববাবুর কাছ থেকে আসছি। এ-বাড়ি আমরা ভাড়া নিয়েছি।”
সিদ্ধিনাথ চোখ কপালে তুলে বলল, “ভাড়া নিয়েছেন? বাড়ি যে পড়ো-পড়ো! শেষে কি বাড়ি-চাপা পড়ে মরার সাধ হল আপনাদের?”
অভিজিৎ বলল, “ফটকটা আগে খুলুন তো মশাই, বাড়িটা নিজের চোখে দেখতে দিন।”
লোকগুলোর চেহারা, পোশাক-আশাক বাবুদের মতো হলেও কেমন যেন মানুষগুলোকে বিশেষ পছন্দ হল না সিদ্ধিনাথের। কিন্তু সে হল হুকুমের চাকর। কোমরের কার-এ বাঁধা চাবি দিয়ে ফটকের তালা খুলে দিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল, “দেখে নিন।”
আশ্চর্যের বিষয়, লোকগুলো বাড়িটা ঘুরে-ফিরে দেখে পছন্দ করে ফেলল। বলল, “বাঃ, দিব্যি বাড়ি।”
অভিজিৎ নামে লোকটি হঠাৎ ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’তে নেমে সিদ্ধিনাথকে বলল, “তা, তুমি এখানে কত দিন আছ হে বাপু?”
“সে কি আর মনে আছে ভাল করে! তবে চল্লিশ বছর তো হবেই।”
“তা, তোমার দেশে-টেশে যেতে ইচ্ছে করে না?”
“দেশে যেতে?”
‘হ্যাঁ হে। যাও না, দেশ থেকে কিছু দিন ঘুরে-টুরে এসো গিয়ে। আমরা নাহয় থোক কিছু টাকা দিচ্ছি তোমাকে।”
সিদ্ধিনাথ মাথা চুলকে বলল, “দেশ একটা ছিল বটে মশাই। এখান থেকে বিশ-মাইলটাক ভিতরে। বিশ বছর আগেও এক খুড়ি বেঁচে ছিল সেখানে। মাঝে-মাঝে যেতুম। বিশ বছর হল খুড়িমা মরে অবধি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে গেছে।”
অভিজিৎ একটু হেসে বলল, “তা, দেশে না যাও, তীর্থ-টির্থও তো করতে যেতে পারো। এক জায়গায় এত দিন একনাগাড়ে থাকতে কি ভাল লাগে?”
সিদ্ধিনাথ এবার একটু ভেবে বলল, “সেটা একটা কথা বটে। এত কাছে কলকাতার কালীঘাট, সেটা অবধি দেখা হয়ে ওঠেনি।”
“কালীঘাট যাও, হরিদ্বার যাও, কাশী যাও। ঘুরে-টুরে এসো তো! এখন আমরা এসে গেছি, বাড়ি পাহারা দেওয়ার তো আর দরকার নেই।”
‘কথাটা মন্দ বলেননি। আচ্ছা, বাবুকে বলে দেখি।”
অভিজিৎ মোলায়েম গলায় বলল, “তার দরকার কী? মাইনে তো তোমাকে আমরাই দেব, সুতরাং আমরাই এখন তোমার বাবু। আমরা যখন তোমাকে ছুটি দিচ্ছি, তখন আর তোমার ভাবনা কী?”
সিদ্ধিনাথ মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে। তা আপনারা কবে বাড়ির দখল নিচ্ছেন?”
“আজই। আমাদের সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র আর যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলো এ-বেলাই চলে আসবে। তুমি একটু ঝটপাট দিয়ে দাও ঘরগুলো।”
সিদ্ধিনাথ মিনমিন করে বলল, “বাড়ির অবস্থা কিন্তু ভাল নয় গো বাবুরা। কোন্ দিন যে হুড়মুড় করে পড়বে, তার কিছু ঠিক নেই কিন্তু।”
তার কথায় অবশ্য কেউ কান দিল না।
বাবুরা যে অন্য ধাঁচের, তা বুঝে নিতে বেশি সময় লাগল না সিদ্ধিনাথের। এরা সব শহর-গঞ্জের লোক, মেলা লেখা-পড়া করেছে, চটাস-পটাস করে ইংরেজি বলে। এরা নিশ্চয়ই ভূত-প্রেত মানে না, ভগবানকেও মানে কি না সন্দেহ। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ভূতেরাও কখনও ভুলেও এ সব বাবুদের কাছে ঘেঁষেন না, সুতরাং এদের কাছে এ বাড়ির ভূতের বৃত্তান্ত বলে লাভ নেই।
সিদ্ধিনাথ ঘর-দোর ভাল করে ঝট-পাট দিয়ে ঝুল ঝেড়ে দিল।
বাগানটায় বড় জঙ্গল হয়েছে। আগে সিদ্ধিনাথ গাছ-টাছ লাগাত, আগাছা তুলে ফেলত। আজকাল আর পণ্ডশ্রম করতে ইচ্ছে যায় না। ফলে বাগানটা একেবারেই জংলা গাছে ভরে গেছে।
কোদাল কুড়ল কাঁচি নিয়ে সিদ্ধিনাথ বাগানটা পরিষ্কার করতে উদ্যোগ ছিল। বাবুরা ধেয়ে এল হাঁ-হাঁ করে। অভিজিৎ বলল, “খবরদার, ও কাজও করো না। আগাছার জন্যই বাড়িটা আমরা ভাড়া নিয়েছি।”
আগাছায় কার কী কাজ তা জানে না সিদ্ধিনাথ। তবে পরিশ্রম বেঁচে যাওয়ায় খুশিই হল সে। কিন্তু ভুতুড়ে জংলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে শহুরে বাবুরা কী করতে চায়, তা তার মাথায় কিছুতেই সেঁধোল না। তাকে দেশে যেতে বলছে, তীর্থ করতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে, এটাও তেমন সুবিধের ঠেকছে না সিদ্ধিনাথের। তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে কি?
সদাশিবকতার বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর তেমন ভরসা নেই সিদ্ধিনাথের। নামে যেমন সদাশিব, কাজেও তেমনি বোম-ভোলানাথ। দুটো মন রাখা কথা বললেই একেবারে গলে। জল হয়ে যান। তবু তার কানে কথাটা তোলা দরকার। সিদ্ধিনাথ ফরসা ধুতি আর পিরান পরে, মাথায় একটা পাগড়ি বেঁধে লাঠিগাছ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
পথে শ্রীপতির মুদির দোকান। সিদ্ধিনাথ দোকানের বাইরে একখানা বেঞ্চে বসে পড়ে, পাগড়ির ন্যাজ দিয়ে মুখ মুছে বলল, “ওরে, শ্রীপতি, শুনেছিস বৃত্তান্ত?”
“না গো সিদ্ধিনাথদা। বৃত্তান্তটা কী?”
“ঝিলের বাড়ি ভাড়া হল রে! একেবারে ফিটফাট সব বাবুরা এসে গেল।”
“বলো কী গো? তাই দেখছিলুম বটে একখানা ঢাকনা-খোলা জিপ গাড়ি হাঁকড়ে কারা সব যাতায়াত করছে।
“তারাই। ও দিকে বাড়ি যে কখন মাথার ওপর ভেঙে পড়ে, তার ঠিক নেই।”
“তা, ওই ভূতের বাড়িতে কি তিষ্টোতে পারবে? তোমার মতো ডাকাবুকো লোক পারে বলে কি আর সবাই পারে? তে-রাত্তির কাটবার আগেই চোঁ-চাঁ দৌড় দিয়ে পালাবে।”