অভিজিতের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, “কথাটা আপনি ভুল বলেননি। বাঙালিরা–ওই আপনি যা বললেন, “তাই–ভেতো, তেঁতো আর তেতো। তবে আমার শিক্ষাটা হয়েছিল বিদেশে। সেখানে দিনের মধ্যে আঠেরো ঘণ্টা খাটতে হয়। তাই আমি পুরোপুরি বাঙালি হয়ে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমার কাজটা কতদূর সাঙ্ঘাতিক তা আমিও জানি না। এমনও হতে পারে যে, সব পরিশ্রমই পণ্ড হয়ে যাবে, কিছুই ঘটবে না। কিন্তু যে-কোনও সত্যানুসন্ধানীকে তো এ রকম হতাশার মুখোমুখি বার বারই হতে হয়।”
সদাশিববাবু ছোঁকরার কথাবার্তা শুনে অখুশি হলেন না। কথাগুলো খুব খারাপ তো বলছে না। তিনি নড়েচড়ে বসে বললেন, “তা বেশ। কাজ করার ইচ্ছে তো খুবই ভাল। বাঙালিরা কিছু করলে আমি খুশিই হই।”
“তা হলে বাড়িটা কি আমরা ভাড়া পাব?”
সদাশিববাবু একটু চিন্তা করলেন। তার পর বললেন, “ও-বাড়িতে বহুকাল কেউ থাকেনি, সংস্কারও কিছু হয়নি, বুড়ো দারোয়ান সিদ্ধিনাথই যা দেখাশোনা করে। তাকে অবশ্য মাইনে দিয়ে পুষতে হয়। আমি বলি কি, আমাকে ভাড়া দিতে হবে না, তোমরা যে ক’ মাস থাকবে, সিদ্ধিনাথকে মাসে-মাসে চারশো টাকা করে দিয়ে দিও।”
অভিজিৎ মাথা নেড়ে বলল, “আমরা রাজি।”
“আর সাফ নুতরো যা করবার, তাও তোমাদেরই করিয়ে নিতে হবে।”
অভিজিৎ খুব বিনীত ভাবে বলল, “যে আজ্ঞে। তবে আমরা বাড়িটাতে ইলেকট্রিক ফেন্স লাগাব, জেনারেটর বসাব, ঘরগুলোতে কিছু যন্ত্রপাতি বসাতে হবে। আপনার অনুমতি চাই।”
“ঠিক আছে। যা করার করো। আর ইয়ে, মাঝে-মাঝে এসে দেখা করে যেও। কেমন কাজকর্ম হচ্ছে ব’লো। কোনও অসুবিধে হলে তাও জানিও। আগেই বলছি, ও-বাড়িতে সাপখোপ থাকতে পারে। আর সিদ্ধিনাথ নাকি প্রায়ই ভূত দেখে।”
এবার তিনজনেই চাপা হাসি হাসল।
চা খেয়ে অতিথিরা বিদায় নিল।
সদাশিব বন্দুক পরিষ্কার করতে বসলেন। বসে ভাবতে লাগলেন, কাজটা ঠিক হল কি না।
২. ডাকাতে ঝিলের তিন পাশে
ডাকাতে ঝিলের তিন পাশে যে নিবিড় জঙ্গল আর ভুসভুসে কাদা, তাতে জায়গাটা মানুষের পক্ষে প্রায় অগম্য। দিনের বেলাতেই জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার ঘনিয়ে থাকে। ঝিলের জলেও বিস্তর আগাছা আর কচুরিপানা জন্মেছে। বহু দিন এই দৃষিত জল কেউ ব্যবহার করেনি। এমনকী, স্নান করতে বা মাছ ধরতেও কেউ আসে না।
ঝিলের দক্ষিণ ধারে একখানা পুরনো বড় বাড়ি। বাড়িটার জীর্ণ দশা বাইরে থেকে বোঝা যায়। সিদ্ধিনাথ দিন রাত শুনতে পায়, বাড়িটার ভিতরে ঝুরঝুর করে চুন বালি খসে পড়ছে। মেঝেয় গর্ত বানাচ্ছে ইঁদুর। আরশোলা, উইপোকা, ঘুণ, বিছে, তক্ষক, কী নেই এই বাড়িতে? আর যারা আছেন, তাঁদের কথা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। রাতের বেলায় কত শব্দ হয় বাড়ির মধ্যে, কত খোনা গলার গান, হাসি শোনা যায়। সিদ্ধিনাথ তখন আউট হাউসে নিজের ছোট ঘরখানায় কাঠ হয়ে থাকে। সিদ্ধিনাথ আগে রোজ ঝাড়পোঁছ করত। আজকাল হাল ছেড়ে দিয়েছে। সপ্তাহে এক দিন করে সে বাড়িটা ঝাড়পোঁছ করে বটে, কিন্তু বুঝতে পারে, নড়বড়ে বাড়িটার আয়ু আর বেশি দিন নয়। হঠাৎ ধসে পড়ে যাবে।
বাড়ির পিছন দিকে বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি নেমে গেছে ঝিলের জলে। সিঁড়ির অবস্থা অবশ্য খুবই করুণ। মস্ত মস্ত ফাটল হাঁ করে আছে। তার মধ্যে কচ্ছপেরা ডিম পেড়ে যায়। ঢোঁড়া সাপ আস্তানা গাড়ে। পোকা-মাকড় বাসা বেঁধে থাকে। কোথাও কোথাও শান ফাটিয়ে উদ্ভিদ উঠেছে।
সিদ্ধিনাথই একমাত্র লোক, যে ঝিলের জল ব্যবহার করে। এই জলে সিদ্ধিনাথ কাপড় কাঁচে, বাসন মাজে, স্নান করে। তার অসুখ করে না। গত চল্লিশ বছর ধরে সদাশিববাবুর এই বাড়িখানায় পাহারাদারের চাকরি করছে সে। এই চল্লিশ বছর ধরে প্রায় প্রতি দিনই সে ঘাটের সিঁড়ি কত দূর নেমে গেছে, তা ডুব দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে। তার কারণ, কিংবদন্তী হল, এই সিঁড়ির শেষে, ঝিলের একেবারে তলায় কোনও গহিন রাজ্যে একখানা মন্দির আছে। সেখানে ভারী জাগ্রত এক দেবতা আছেন। যে একবার সেখানে পৌঁছতে পারবে, তার আর ভাবনা নেই। দুনিয়া জয় করে নেওয়া তার কাছে কিছুই নয়।
সিদ্ধিনাথ বহু দিনের চেষ্টায় এ-পর্যন্ত জলের তলায় ষাটটা সিঁড়ি অবধি যেতে পেরেছে। তারও তলায় সিঁড়ি আরও বহু দূর নেমে গেছে। কোনও মানুষের পক্ষে তো দূর নেমে যাওয়া সম্ভব নয়।
সিদ্ধিনাথ পারেনি বটে, কিন্তু আজও সে প্রায়ই ঘাটের পৈঠায় বসে জলের দিকে চেয়ে থাকে।
আজ সকালে ঘাটে বসে যখন আনমনে নানা কথা ভাবছিল, তখন হঠাৎ কেমন যেন মনে হল, কেউ আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সিদ্ধিনাথ চার দিকে তাকিয়ে দেখল। কোথাও কেউ নেই। দিব্যি রোদ উঠেছে। ঠাণ্ডা বাতাস হাড় কাঁপিয়ে বয়ে যাচ্ছে, পাখি ডাকছে। ঝিলের ও পাশে নিবিড় জঙ্গলে অন্ধকার জমে আছে।
সিদ্ধিনাথ গায়ের চাঁদরখানা আর-একটু আঁট করে জড়িয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর আবার তার কেমন মনটা সুড়সুড় করে। উঠল। তার দিকে কে যেন আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে।
সিদ্ধিনাথ ভারী অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এ রকম অনুভূতি তার বড় একটা হয়নি কোনও দিন। এই নির্জন জায়গায় কে আসবে, আর কারই বা দায় পড়েছে সিদ্ধিনাথের দিকে তাকিয়ে থাকার?
সিদ্ধিনাথ উঠে চার দিকে ঝোঁপঝাড় ঘুরে দেখল। হাতের লাঠিটা দিয়ে ঝোঁপঝাড় নেড়ে-চেড়ে দেখল। কেউ নেই।