নবীনের ইচ্ছে হচ্ছিল, কুলদা চক্কোত্তির টিকিটা ধরে আচ্ছাসে নেড়ে দেয়। নবীনের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আর খিটকেলে ভূতটা বকবক করে যাচ্ছে।
কুলদা চক্রবর্তীর অবশ্য কোনও বৈলক্ষণ নেই। ফিসফিস করে বলল, “বুঝলে, এই এত বছর বাদে কালীচরণের রাগ কিছু পড়েছে বলেই মনে হয়! যদি ভগবান মুখ তুলে চান, তবে চাই কি, ফের পুরুতগিরিতে বহালও করতে পারে। তা সে কথা যাক গে, এই গুণ্ডাটা দেখছি তোমাকে বেশ পেড়ে ফেলেছে…ই, তোমার যে একেবারে ল্যাজে-গোবরে অবস্থা! তা একটা কাজ করো, বাঁ পা-টা ভাঁজ করে ওপরে তুলে ঘোড়া যেমন চাঁট মারে, তেমনি একখানা ঝাড়ো তো বাপু?”
নবীনের জ্ঞান ধীরে-ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। তবু একথাটা সে শুনল। বাঁ পা-টা তুলে চড়া করে একখানা গোড়ালির গুঁতো বসিয়ে দিতে পারল লোকটার পিঠে। উপুড় হয়ে পড়ে থেকে এর বেশি আর সম্ভবও নয়।
লাথিটা কষাতেই ঘাড়ের চাপটা অর্ধেক কমে গেল হঠাৎ। আর সেই সুযোগে নবীন একটা ঝটকা মেরে পিঠের ওপর থেকে লোকটাকে ছিটকে ফেলে মাটিতে একপাক গড়িয়ে গেল।
তার পর সে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল নোকটার ওপর। এরাই না তাদের তিনজনকে কুয়োর মধ্যে খুন করতে চেয়েছিল? এরাই না বোমা ছুঁড়ে মেরেছিল? দুটি শিশুকেও এই পাষণ্ডরা মায়া করেনি।
নবীনের গোটা পাঁচ-ছয় ঘুসি খেয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে গেল। নড়ল না।
নবীন উপুড় হয়ে লোকটাকে পরীক্ষা করে দেখল। কোমরের বেল্ট থেকে একটা টর্চ জ্বলছিল, সেটা খুলে নিয়ে নবীন লোকটার মুখে আলো ফেলল। অচেনা মুখ। তবে লোকটা যে শহরের, তাতে সন্দেহ নেই। পকেট-টকেটও হাতড়ে দেখল নবীন। না, কোনও অস্ত্র নেই। এমনকী, একটা লাঠিও না।
নবীন ধীর পায়ে বাড়ির বারান্দায় উঠল। একটা, দরজা টানতেই খুলে গেল ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ করে।
ভিতরে ঢুকে চার দিকে আলো ফেলল নবীন। সামনের বড় ঘরটায় কয়েকটা বাক্স-প্যাটরা রয়েছে। এখনও ভোলা হয়নি।
পরের ঘরটায় একটা পোর্টেবল র্যাকের ওপর দুটো মাইক্রোস্কোপ আর অনেকগুলো জার রয়েছে। কয়েকটা জাল-লাগানো কাঠের বাক্সও।
নবীন এ-ঘরটা পার হয়ে পরের ঘরটায় ঢুকতে গিয়ে ভিতরে অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে সভয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে, কোনও বিচিত্র হিংস্র প্রাণীর আওয়াজ।
একটু বাদেই তার ভুল ভাঙল। কোনও হিংস্র প্রাণী নয়, দুটো ক্যাম্প-খাটের ওপর দুজন লোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে আর তাদের নাক ওই রকম ভয়ঙ্করভাবে ডাকছে।
নবীন দু’জনের মুখেই টর্চের আলো ফেলল। শহরের লোক, ঘুমন্ত মুখ দেখে কিছু বোঝবারও উপায় নেই, এরা কেমন লোক। তবে এদের একজনকে সে চেনে। অভিজিৎ। সদাশিববাবু আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এই লোকটাই ঘুরঘুর করছিল তার বাড়ির বাগানে।
হঠাৎ লোকটার নাকের আওয়াজ থেমে গেল। লোকটা চোখ মেলে তড়াক করে উঠে বসে বলল, “কে?”
নবীন টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, “ভয় নেই। আমার নাম নবীন।”
“ওঃ নবীনবাবু! এত রাতে কী ব্যাপার?”
“আমি জানতে চাই, আপনারা কারা?”
অভিজিৎ একটু বিরক্ত গলায় বলল, “এত রাতে ঘুম ভাঙিয়ে এটা কী ধরনের রসিকতা?”
“রসিকতা নয়। পরিচয় জিজ্ঞেস করার গুরুতর কারণ আছে। গত কয়েক ঘণ্টা যাবৎ কয়েকজন খুনে লোক বন্দুক-পিস্তল নিয়ে আমাকে তাড়া করছে। তারা আমাকে খুন করতে চায়। কিন্তু কেন চায় এবং তারা কারা, তা আমার জানা দরকার।”
অভিজিৎ একটু বিগলিত গলায় বলল, “তারা কারা, তা আমিই বা কী করে বলব? আপনার কি সন্দেহ যে, আমরাই আপনাকে খুন করার চেষ্টা করছিলাম?”
“কেটেরহাটে এমন কোনও লোককে আমি জানি না, যার কাছে বন্দুক-পিস্তল বা বোমা আছে।”
“কেন, সদাশিববাবুরই তো আছে।”
“তা আছে। তবে তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি।”
অভিজিৎ উঠে একটা লণ্ঠন জ্বালল। তার পর নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “আরে, আপনি যে শীতে কাঁপছেন! সবাঙ্গ ভেজা!”
“হ্যাঁ, আমি ঝিল থেকে একটু আগেই উঠে এসেছি।”
“আপনি কি পাগল? এই প্রচণ্ড শীতে ঝিলে নেমেছিলেন কেন?”
“সে কথা পরে। আপনাদের মতলব কী বলুন তো? আপনারা আসার পরেই কেন এ সব ঘটনা ঘটছে? সিদ্ধিনাথকে আপনারা তাড়াতে চেয়েছিলেন, না-পেরে তাকে মেরে যমের দক্ষিণ দোরে পৌঁছে দিয়েছেন। ভুজঙ্গের মাথা ফাটিয়েছেন, সদাশিবের দুটো ফুলের মতো নাতি-নাতনি আর আমাকে গুলি করে মারতে চেয়েছেন।”
অভিজিৎ এ সব কথার কোনও জবাব দিল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের কাছে বন্দুক একটা আছে বটে, কিন্তু সেটা ডাকাতের ভয়ে রাখতে হয়েছে। যদি বিশ্বাস না হয়, তবে নিজেই খুঁজে দেখতে পারেন। আমরা পোকা-মাকড় নিয়ে রিসার্চ করতে এসেছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। সিদ্ধিনাথ বা ভুজঙ্গকে কে মেরেছে, তাও আমরা জানি না। তবে গতকাল বিকেলে আমরা বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি, সদর দরজায় কে আঠা দিয়ে একটা কাগজ সেঁটে রেখে গেছে। আমরা কাগজটা খুলে রেখেছি। আপনিও দেখতে পারেন।”
এই বলে অভিজিৎ টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নবীনের হাতে দিল। নবীন দেখল, তাতে লেখা : চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এ-জায়গা ছেড়ে চলে না গেলে মরতে হবে।
নবীন কাগজটা অভিজিতের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনাদের একজন একটু আগে বাগানে আমাকে আক্রমণ করেছিল। আপনারা যদি ভাল লোকই হবেন, তা হলে গুণ্ডা পুষেছেন কেন? যে আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল?”