বিছানার চাঁদরটা টান-টান করে রাখল নবীন, যাতে বোঝ না যায় যে, বিছানায় কেউ শুয়েছিল।
তার পর নিঃশব্দে পাতালঘরের দিকে নেমে গেল নবীন।
দরজাটা এমনভাবে বন্ধ করেছিল, যাতে বাইরে থেকে খোলা যায়। ঘরে ঢুকে দরজাটা ফের বন্ধ করে দিয়ে নবীন ভাবতে বসল, এখন কী করা যায়? যারা পিছু নিয়েছিল, তারা যে চাঁপাকুঞ্জের সুড়ঙ্গ এবং ভিতরকার গুপ্তধনের কথা জানে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। সশস্ত্র এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির এই লোকগুলোর বিরুদ্ধে নবীন কী করতে পারে?
নবীন কিছুক্ষণ ভাবল, এভাবে ইঁদুরের মতো গর্তে সেঁধিয়ে আত্মরক্ষা করা বেশিক্ষণ সম্ভব নয়। এভাবে বাঁচা যাবে না, বরং রহস্য উদঘাটনের চেষ্টাটাই বেশি নিরাপদ হবে।
নবীন জানে, খুনেরা যত বেপরোয়াই হোক, তারা এই শীতে জলে-ডোবা সুড়ঙ্গে কিছুতেই নামবার ঝুঁকি নেবে না। নবীনও নিত না। প্রাণের ভয়ে তারা ওই সাঙ্ঘাতিক কাজ করেছে। সুতরাং মন্দিরের সুড়ঙ্গ এখনও নিরাপদ।
নবীন সুড়ঙ্গের দরজা খুলে সরু সিঁড়ি ধরে নামতে লাগল। এ সবই তার পূর্বপুরুষেরা করে গেছেন। অনেক পরিশ্রম আর অনেক অর্থ ব্যয় করে তাঁরা তাঁদের ধনসম্পদ আর বিগ্রহকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন।
নবীন সিঁড়ির শেষে সরু গলিটা পেরিয়ে এসে ফের মন্দিরে ঢুকল। আর একটা দরজা এখনও দেখা হয়নি। ও দিকটায় কী আছে তা জানা দরকার।
নবীন মন্দিরের চতুর্থ দরজাটা দিয়ে আবার একটা গলিতে এসে দাঁড়াল। গলিটা ঢালু হয়ে খানিকটা নেমে গেছে। তার পর আবার ওপরে উঠেছে। তার পর খাড়া নেমে গেছে সোজা জলের মধ্যে।
ফের জল দেখে থমকে গেল নবীন। ভারী হতাশও হল। ফিরে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। রাস্তাটাকে ইচ্ছে করেই কি
এত দুর্গম করা হয়েছিল? নাকি প্রকৃতির নিয়মে রাস্তা ধসে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছে, তা চট করে বুঝে ওঠা মুশকিল। নবীন গলির দু ধারের দেওয়াল ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল, কোনও ফাটল বা গুপ্তপথ আছে কি না। নেই।
নবীন ফিরেই আসছিল। হঠাৎ জলে একটা ঝটপট শব্দ হওয়ায় ফিরে দেখল, মস্ত একটা কাতলা মাছ অল্প জলে খেলা করছে। টর্চের আলো দেখে ফিরে চলে গেল।
কেমন যেন মনে হল নবীনের, মাছটার এই হঠাৎ আসা আর যাওয়ার মধ্যে কোনও একটা ইঙ্গিত আছে। তাকে কি জলে নামতেই বলছে কেউ?
প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় একবার জলে ভিজে কষ্ট পেতে হয়েছে। আবার ভিজলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া। কিন্তু উপায়ই বা কী? জলের তলায় কী আছে না আছে, তা না জানলে এই জট খোলা যাবে?
নবীন তার গায়ের চাঁদর খুলে ফেলল। জুতো ছাড়ল, কী ভেবে টর্চটাও রেখে দিল। তার পর ধীরে-ধীরে বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে নেমে গেল।
ডুব না দিয়ে উপায় নেই। এখানেও সুড়ঙ্গটা সোজা জলে নেমে গেছে। কোথায় উঠেছে, কে জানে?
নবীন বুকভরে দম নিয়ে জলে ডুব দিল। তার পর প্রাণপণে সাঁতার দিতে লাগল।
এবার আর বেশি দূর যেতে হল না। হাত-দশেকও নয়, নবীন মাথা তুলতেই দেখল, মাথার ওপর ফাঁকা, দম নেওয়া যাচ্ছে।
নবীন ফিকে অন্ধকারে চার দিকে চেয়ে যা দেখল, তাতে তার চোখ স্থির। সে বড় ঝিলের মাঝ বরাবর জলে ভাসছে। তিন দিকে বিশাল ঝিল আর জঙ্গল, একধারে ঝিলের ধারের বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা-মাখা আবছা অন্ধকারে।
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো নবীনের মনে পড়ে গেল, ওই বাড়িতে কবে যেন ভাড়াটে এসেছে বলে বলছিল সিদ্ধিনাথ? নতুন ভাড়াটে? তারা কারা?
নবীন নিঃশব্দে দ্রুত গতিতে ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। তার পর সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল পৈঠায়।
একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে গায়ের জামা-টামা খুলে যতদূর সম্ভব নিংড়ে নিল সে। গা-হাত-পা মুছে নিল নিজের ভেজা জামা-কাপড় দিয়েই। তার পর বাগানের গাছপালার আড়াল দিয়ে এগোতে লাগল বাড়িটার দিকে।
পুরনো ঝুরঝুরে বাড়ি। অন্ধকার, জনমনিষ্যি কেউ আছে বলে মনে হল না নবীনের। ১১০
সে পিছনের বারান্দায় উঠে সাবধানে দরজাগুলো একে-একে টেনে দেখল। সবই ভিতর থেকে বন্ধ। রাস্তার দিকে বাড়ির সদর। নবীন বাড়িটা ঘুরে সামনে চলে এল। একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে লক্ষ করে দেখল। কেউ আছে বলে মনে হল না। ভাড়াটেরা হয় বেরিয়ে গেছে, নয়তো ঘুমোচ্ছে। বাইরে কোনও পাহারা নেই।
নবীন ঝোঁপের আড়াল থেকে উঠে এক-পা এগোল, পিছনে সামান্য মড়মড় শব্দ…নবীন ফিরে তাকাতে যাচ্ছিল..হঠাৎ তার ঘাড়ে ভালুকের মতো কে যেন লাফিয়ে পড়ল।
প্রথম ধাক্কাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল নবীন।
দুটো লোহার মতো হাত তার ঘাড়টা শক্ত করে ধরে মুখটাকে ঠেসে রইল মাটিতে। নবীন দম নিতে পারছে না। প্রবল চাপে তার চোখ ফেটে জল এল।
ধীরে-ধীরে সাঁড়াশির মতো দুটো হাত আরও চেপে বসল ঘাড়ে। একটা হাঁটু চেপে রেখেছে তার কোমর।
নবীনের গায়ে যে জোর কম, তা নয়–তবে আচমকা এই আক্রমণে সে বড় বেকায়দায় পড়ে গেছে।
কানের কাছে আবার সেই ‘খুক’ শব্দ। একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল, “ভাল খবর আছে হে। একটু আগে চাঁপাকুঞ্জের শ্মশানে কালীচরণের সঙ্গে দেখা, বুঝলে? দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি সটকে পড়ছিলাম। তা হঠাৎ হল কী, জানো? কালীচরণ এই দেড়শো কি পৌনে দু’শো বছর পর হঠাৎ আমার সঙ্গে কথা কইল। কী কইল জানো? কইল, “ওহে চখোত্তি, ওই নবীন ছোঁড়াটা একটু পাগলা বটে, কিন্তু আমার বংশের শিবরাত্তিরের সলতে, মনে হচ্ছে, বিপদে পড়বে, ওকে একটু দেখো।”