নবীন বলল, “ঠিক আছে। তোমাদের কথাই থাকবে। কিন্তু আজ রাতের মতো যথেষ্ট হয়েছে। তোমাদের দাদু আর ঠাকুমা ভীষণ দুশ্চিন্তা করছেন। এবার তোমরা বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করো। কাল রাতে আবার আমরা সুড়ঙ্গে নামব।”
অনু সন্দিহান হয়ে বলল, “আমাদের ফাঁকি দিচ্ছ না তো?”
“না।”
“তা হলে কথা দাও।”
“দিচ্ছি।”
নবীন দুই ভাই-বোনকে তাদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল। ফটকে বচন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দেখে দৌড়ে এসে বলল, “এসেছ? বাঁচা গেল। বাবুকে বলেছি, তোমরা যাত্রা দেখছ। বাবু আর গিন্নিমা তবু ঘুমোননি। ওপরতলায় বসে আছেন। তোমাদের এ কী দশা?”
নবীন বলল, “সে অনেক কথা বচন, পরে শুনো। খুব জোর বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছি। ওদের আগে নিয়ে গিয়ে শুকনো জামাকাপড় পরিয়ে কিছু খাওয়াও। কতবাবু যেন টের না পান। পরে আমি সব বুঝিয়ে বলব’খন তাঁকে।”
বচন মাথা নেড়ে বলল, “কোনও চিন্তা নেই।” নবীন নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এল।
নবীন বাড়ি ফিরে সোজা পাতালঘরে নেমে এল। সুড়ঙ্গের দরজাটা খুব আঁট করে বন্ধ করে দিল সে। তার পর অন্য দরজাটাও বন্ধ করে সে ওপরে উঠে এল। জামা-কাপড় পালটে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় কম্বল-মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সে।
আচমকাই কানের কাছে একটা খুক’ শব্দ। তার পর কানে-কানে সেই পরিচিত ফিসফিস আওয়াজ। “বাপের ব্যাটার মতো একটা কাজ করলে বটে হে। ওই চতুর্ভুজের মন্দিরে আমি এক সময়ে পুজুরি ছিলুম।”
নবীন একটু রেগে গিয়ে বলল, “মেলা ফ্যাচফ্যাচ করবেন না তো! আপনি কোথাকার পুজুরি ছিলেন, তা জেনে আমার লাভটা কী? বিপদের সময় তো আপনার টিকিটিরও নাগাল পাওয়া গেল না। জলে-ডোবা সুড়ঙ্গের মধ্যে আমরা যখন মরতে বসেছিলাম, তখন কোথায় ছিলেন? এখন যে ভারী আহ্লাদ দেখাতে এসেছেন!”
কণ্ঠস্বরটা একটু নিবু নিবু হয়ে বলল, “সুড়ঙ্গের মধ্যে কি আর সাধে ঢুকিনি রে ভাই? তোমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠপুরুষ কালীচরণকে দেখলে না? ইয়া গোঁফ, অ্যাই গালপাট্টা, ইয়া বুকের ছাতি, হাতির পায়ের মতো প্রকাণ্ড হাত, থামের মতো পা নিয়ে সুড়ঙ্গের মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল।”
“কই, দেখিনি তো!”
“দ্যাখোনি যে ভালই করেছ, অশরীরী তো! তবে দেখলে মূর্ছা যেতে, তাকে দেখেই আমি মানে-মানে সরে পড়েছিলাম।”
“তাঁকে আপনার ভয় কী?”
“ও রে বাবা! সে অনেক কথা। চতুর্ভুজের মন্দির থেকে ওই কালীচরণই আমাকে তাড়িয়েছিল। দোষঘাট যে আমার ছিল না, তা নয়। চতুর্ভুজ স্বপ্নদেশ দিয়েছিলেন, নরবলি দিতে হবে। কালীচরণকে বলেও ছিলাম সেকথা। সে কানে তুলল না। বলল, তুমি আফিংয়ের ঘোরে কী সব আগডুম বাগড়ম দেখেছ, তাই বলেই কি তা মানতে হবে নাকি? কিন্তু আমার ভয় হল; স্বপ্নাদেশ না মানলে যদি মহা সর্বনাশ হয়ে যায়। তাই একটা গরিব বামুনের পাঁচ বছর বয়সের ছেলেকে চুরি করে আনি। পাতাল-মন্দিরের বাইরের কাকপক্ষীও টের পাবে না। কালীচরণও তখন ছিল না। কিন্তু কী বলব তোমায়, সেই পাঁচ বছরের ছেলের যে কী তেজ! এই হাত-পা ছিটকে বাঁধন প্রায় ছিঁড়ে ফেলে, কাছে গেলেই কামড়ে দিতে চায়। সে এক জ্বালাতন। শেষে অতিরিক্ত ছটফট করায় মাথা পাথরে টুকে রক্তপাত হল। খুত হলে তো আর বলি দেওয়া যায় না, সুতরাং দেরি হয়ে গেল। আর তা করতে গিয়ে কালীচরণ ফিরে এল। ওঃ কী মারটাই মেরেছিল আমায়! তিনটে দাঁত পড়ে গেল, একটা চোখ ফুলে ঢোল, হাড়গোড় আর আস্ত রাখেনি। ঘাড় ধরে বের করে দিল মন্দির থেকে। সেই থেকে গুণ্ডটাকে বড্ড ভয় খাই। তবে চতুর্ভুজের মন্দিরটার জন্য এখনও মনটা কেমন করে।”
নবীন বলল, “আপনি তো ভীষণ খারাপ লোক ছিলেন দেখছি।”
কুলদা চক্রবর্তীর ভূত ভারী দুঃখের সঙ্গে বলল, “সবাই বলত বটে কথাটা, আমি নাকি খারাপ লোক। এমনকী, আমার ব্রাহ্মণীও বলত, তুমি একটা পাষণ্ড। আমার বাবা বলত, তুই ব্রাহ্মণ বংশের কুলাঙ্গার। কিন্তু মুশকিল কী জানো, আমি নিজে কিন্তু কখনও টের পাইনি যে, আমি খুব একটা খারাপ লোক। নিজেকে আমার বরাবর বেশ ভাল লোক বলেই মনে হত।”
“খারাপ লোকেরা নিজের খারাপটাকে যে দেখতে পায় না।”
“তাই হবে। কিন্তু আমি যদি তেমন খারাপ হতুম, তা হলে কি আর খোকা-খুকি দুটির বিপদের কথা জানিয়ে তোমাকে পথ দেখিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঠিক জায়গাটিতে নিয়ে যেতুম? ওরে বাবা, আমাকে লোকে যতটা খারাপ বলে জানে, আমি ততটা খারাপ নই।”
নবীন বলল, “এখনও আপনাকে আমার ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে না।”
কুলদা চক্রবর্তীর ভূত ফোঁত করে একটা নাক ঝাড়ার শব্দ করে বলল, “এখন যে এসেছি, সেও তোমার ভাল করার জন্যই।”
“তাই নাকি? কী রকম শুনি?”
“যে সব খুনে-গুণ্ডা তোমাদের সুড়ঙ্গের মধ্যে ধাওয়া করেছিল, তারা সব উঠে এসেছে। তোমার খোঁজে এল বলে। যদি প্রাণ বাঁচাতে চাও তো পালাও, অন্তত এ-ঘরটায় আজ রাতে আর শুয়ো না, তাদের অবশ্য ধারণা যে, তুমি ডোবা সুড়ঙ্গের জলে বাচ্চা দুটো-সহ ডুবে মরেছ। তবু তারা দেখতে আসছে, যদি কোনও রকমে বেঁচে গিয়ে থাকো তাৈ নিকেশ করে যাবে।”
“ওরা কারা?”
“তা আমি জানি না বাপু! লোকের ধারণা, ভূত মানেই সর্বজ্ঞ। তাই কি হয় রে ভাই? সব জানলে ভূত থেকে কবে ভগবান হয়ে যেতুম।”
নবীন টের পেল, কুলদা চক্রবর্তীর ভূত গায়েব হয়ে গিয়েছে।
সে উঠে পড়ল। একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। বাড়িতে পিসি আর মহাদেব আছে। খুনেরা হয়তো তাদের কিছু করবে না। কিন্তু এত রাতে ঘুম থেকে তুলে তাদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব। অনু আর বিলুর খোঁজ ওরা করবে কি না, তা সে বুঝতে পারছিল না। তরে মনে হয়, তাকে না পেলে ওরা ধরেই নেবে যে, তার সঙ্গে অনু আর বিলুও ডুবে মারা গেছে।