মন্দিরের চার দেওয়ালে চারটে দরজা। একটা ভেঙে তারা ঢুকেছে, আর তিনটে বন্ধ।
নবীন এক-এক করে চারটে দরজাই খুলে ফেলল। চার দিকে চারটে পথ গেছে। মহা সমস্যা। কোন পথে যাওয়া যায়?
বিলু বলল, “নবীনদা, এসো, ট করে ডিসিশন নিই।”
নবীন একটু চিন্তা করল, তার পর বলল, “এ-জায়গাটা মোটামুটি নিরাপদ। তোমরা ভাই-বোনে এখানেই বসে থাকো, আমি একটু দেখে আসি।”
কিন্তু এই প্রস্তাবে অনু আর বিল রাজি হল না। অনু বলল, “আমাদের আর বিশ্রামের দরকার নেই। আমরাও তোমার সঙ্গে যাব।”
“তা হলে এসো, এক যাত্রায় আর পৃথক ফলের দরকার কী?”
মস্ত প্রদীপটায় আর-একটু ঘি দিয়ে নবীন সেটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এই আলোই আমাদের এখন একমাত্র ভরসা।”
প্রথম দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে খানিক দূর এগিয়ে বোঝা গেল, মেটা নদীর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। খানিক দূর এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, পথটা আবার গিয়ে জলে ডুবে গেছে।
নবীন বলল, “এটাই হয়তো বড় ঝিলের তলা। সিদ্ধিনাথদা এই পথটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে এত দিন। চলো ফিরে যাই।”
তিনজন আবার মন্দিরে ফিরে এল। তার পর বিগ্রহের পিছন দিককার দেওয়ালের দরজাটা দিয়ে এগোতে লাগল। এই পথটা একটা সিঁড়ির মুখে গিয়ে শেষ হয়েছে। সরু একটা খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে।
নিঃশব্দে তিনজন ওপরে উঠতে লাগল। খানিক দূর উঠে একটা গলি পেল তারা। খুবই সঙ্কীর্ণ গলি। খানিক দূর গিয়ে আবার সরু সিঁড়ি।
উঠতে উঠতে এক জায়গায় থেমে যেতে হল। সামনে একটা নিরেট দরজা।
নবীন দরজাটা নাড়া দিল। কিন্তু এ-দরজাটা লোহার তৈরি। বেশ পুরু পাতের। সহজে নড়ল না। এমনও হতে পারে যে, ও পাশে তালা বা হুড়কো লাগানো আছে।
নবীন প্রদীপের আলোয় দরজাটার ওপর থেকে নীচ অবধি ভাল করে দেখল।
অনু বলল, “নবীনদা, এখানে দেওয়াল থেকে একটা শেকল ঝুলছে, টানব শেকলটা?”
নবীন করুণ গলায় বলল, “কিছু না করার চেয়ে কিছু করাই ভাল। টানো।”
অনু শেকলটা খুব টানল। প্রথমটায় কিছু হল না, তার পর কয়েকটা হ্যাঁচকা টান দিতেই দরজার ওপাশে একটা ঘং করে শব্দ হল। একটা হুড়কো বা কিছু যেন খুলে গেল।
এবার খুব সহজেই দরজাটা খুলে ফেলতে পারল নবীন। এবং ঘরে ঢুকে ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
এ কি তার বাড়ির সেই পাতালঘর? তেমনই গোল আকারের?
প্রদীপের আলোয় নবীন আরও যা দেখল, তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঘরের মধ্যে সাতটা বড় বড় মাটির জালা মুখ-ঢাকা অবস্থায় দেওয়ালের সঙ্গে সার দিয়ে দাঁড় করানো। দেওয়ালে মরচে ধরা সড়কি, বল্লম, তলোয়ার ঝুলছে। চারটে গাদা বন্দুকও। মেঝেময় পুরু ধুলোর আস্তরণ।
নবীন হঠাৎ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, “এ যে আমার সেই পাতালঘর!”
“কিসের পাতালঘর নবীনদা?” অনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“আর চিন্তা নেই। আমরা আমাদের বাড়ির তলাকার পাতালঘরে পৌঁছে গেছি। এই ঘরে ঢুকবার অনেক চেষ্টা করেও পারিনি, আজ তোমাদের জন্যই পেরেছি।”
নবীন ব্যগ্র হাতে জালার মুখের ঢাকনা সরাতে লাগল। যা ভেবেছিল, তা-ই। জালার মধ্যে রাশি রাশি সোনাদানা, বেশির ভাগই মোহর আর গয়না।
“ইশ, নবীনদা, তুমি যে বড়লোক হয়ে গেলে?”
নবীন কেমন বিহ্বল হয়ে গিয়ে বলল, “বড়লোক! ঠা, তা এক রকম বলতে পারো।”
নবীন দেখল, ঘরের অন্য দিকে আর-একটা লোহার দরজা রয়েছে। এই দরজাটি তার বাড়িতে ঢোকার রাস্তা, সন্দেহ নেই। দেওয়াল থেকে একটা শেকল ঝুলছে।
নবীন শেকলটা টানল, প্রথমটায় কিছুতেই টানা যাচ্ছিল না, প্রাণপণে তাঁচকা টান মারতেই দরজার ভিতরে একটা গুপ্ত হুড়কো খুলে যাওয়ার শব্দ হল ঘটাং করে। তার পর এক-পাল্লার পুরু দরজাটা ভিতর দিকে টানতেই খুলে যেতে লাগল। অবশ্য বিস্তর শব্দ হল তেলহীন কবজায়।
দরজার ওপাশে সেই চেনা গলি। নবীন কত দিন এইখানে বসে দরজাটা খোলার উপায় চিন্তা করেছে।
আবেগে নবীনের চোখে জল এসে গেল। “কী হল নবীনদা? দাঁড়িয়ে ও রকম ভাবে চেয়ে আছ কেন?” অনু নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।
নবীন চোখ মুছে বলল, “সে অনেক কথা। চলো, রাস্তা পাওয়া গেছে। তোমরাও এখন নিরাপদ। আমার সঙ্গে এসো।”
অনু আর বিলু কোনও কথা বলল না। নীরবে নবীনের পিছু-পিছু চলতে লাগল।
এবার নবীন তার চেনা জায়গায় এসে পড়েছে। সুতরাং পাতালঘর থেকে উঠে আসা কোনও সমস্যাই হল না।
নবীনের বাড়িতে এখন নিশুতি রাত। পিসি তার ঘরে ঘুমোচ্ছ। মহাদেব তার ঘরে।
এতক্ষণ বদ্ধ বাতাসে তাদের ততটা শীত করেনি। কিন্তু এখন বাইরে আসতেই খোলা হাওয়ায় ভেজা শরীরে প্রচণ্ড শীত করে তিনজনেই কেঁপে উঠল।
নবীন তার চাঁদর-টাদর যা পেল, তাই দিয়ে দুই ভাই-বোনকে বলল, “এগুলো গায়ে জড়িয়ে নাও। তার পর চলল, তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার এখন অনেক কাজ আছে।”
অনু সঙ্গে-সঙ্গে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী কাজ নবীনদা?” নবীন ঠাণ্ডা গলায় বলল, “যে বদমাশরা আমাদের খুন করতে চেয়েছিল, এবার তাদের একটু তল্লাশ নিতে হবে।”
অনু সঙ্গে-সঙ্গে বলল, “আমিও যাব।”
নবীন মাথা নেড়ে বলল, “ তা হয় না। কাজটা খুব বিপজ্জনক। ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে তোমাদের আর নিয়ে যেতে পারব না।”
বিলু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “আমরাও তা হলে বাড়ি যাব।”
নবীন দেখল, মহা বিপদ। এরা দুই ভাই-বোন মোটেই ভিতু ধরনের নয়। বরং রীতিমতো শক্তপোক্ত এবং দারুণ সাহসী, যথেষ্ট বুদ্ধিও রাখে। তার চেয়েও বড় কথা, ভীষণ একগুঁয়ে। সহজে এদের হাত এড়ানো যাবে বলে মনে হয় না।