মনে যাই থাক, মুখে একটু নির্ভয় হাসি হেসে নবীন বলল, “ঘাবড়াচ্ছ কেন? সাঁতার জানো তো?”
অনু মাথা নেড়ে বলল, “সাঁতার জেনে তো লাভ নেই, সুড়ঙ্গটা জলের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার মানে জলটা পার হতে হবে ডুব-সাঁতার দিয়ে। জলের ভিতর দিয়ে কতটা যেতে হবে, তা তো জানি না!”
নবীন তার কোটটা খুলে ফেলল। বলল, “আরে সেটা কোনও সমস্যাই নয়। আমি চট করে জলে নেমে দেখে আসছি। যদি পার না হওয়াই যায়, তা হলে অন্য উপায় বের করতে হবে।”
“এই ঠাণ্ডায় তুমি জলে নামবে?”
“আমি কেন, তোমাদেরও হয়তো নামতে হবে, তৈরি থেকো। মনটাকে শক্ত করো, পারবে।”
নবীন সাবধানে জলে পা দিল, তার পর বুক ভরে দম নিয়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে ডুব দিল।
প্রথমটায় অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না সে, শুধু এগিয়ে যেতে লাগল। ঠাণ্ডায় হাত-পা প্রায় অসাড় হয়ে আসছিল তার। কিন্তু বাঁচতেই হবে। এবং বাচ্চা দুটোকে বাঁচাতেও হবে।
তার বলিষ্ঠ হাত ও পায়ের তাড়নায় জল ছিটকে সে হুশ করে মাথা তুলল। বুঝতে পারল, মাথার ওপরটা ফাঁকা। জলের ওপর গুহার ছাদ উঁচুতে উঠে গেছে।
নবীন জলে ভেসে কয়েক সেকেণ্ড বিশ্রাম নিল। হাতে সময় একেবারেই নেই।
বুক-ভরে দম নিয়ে সে আবার ডুব দিয়ে ফিরে চলল। জলের ওপর মাথা তুলে সে দেখল, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। “অনু! বিলু!” প্রথমটায় কেউ সাড়া দিল না।
তার পর খুব ক্ষীণ কণ্ঠে অনু বলল, “নবীনদা! ফিরে এসেছ?”
“হ্যাঁ।”
“এই গলিতে ওরা ঢুকে পড়েছে। আলো ফেলছে। দু বার গুলিও চালিয়েছে। ও পাশে কী দেখে এলে?”
“তোমরা ডুব-সাঁতার দিতে পারবে?”
“পারব। আমরা দুজনেই ভাল সাঁতার জানি।”
“তা হলে ভয় নেই। মিনিট-খানেক ডুব-সাঁতার দিতে পারলেই জলে-ডোবা জায়গাটা পেরিয়ে যাব। ও দিকে মাথার ওপর ফাঁকা জায়গা আছে। তবে তারপর খানিকটা সাঁতরাতে হবে! গায়ের ভারী জামাগুলো খুলে ফ্যালো। আর আমার লাঠিটা দুজনেই চেপে ধরো। আমি টেনে নিয়ে যাব।”
দুই ক্লান্ত ভাই-বোন কোট-টোট ছেড়ে ফেলল। তারপর লাঠি ধরে জলে নামল। বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে নামতেই ঠকঠক করে কেঁপে উঠল দুজন।
কিন্তু ঠিক এই সময়েই দুম করে একটা বিকট আওয়াজে গলিটা কেঁপে উঠল।
লাঠিটা চেপে ধরে অনু, বিলু আর নবীন দম বন্ধ রেখে জলে ডুবে পড়ল।
নিকষ কালো জলের মধ্যে শুধু লাঠিটাই তাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ।
নবীন প্রাণপণে এগোচ্ছিল। তবে এক-হাতে লাঠি ধরে-থাকায়, খুব জোরে সাঁতারাতে পারছিল না সে।
কিন্তু প্রাণের ভয় বড় ভয়।
আচমকাই নবীন টের পেল, অসাড় হাত থেকে কখন লাঠিটা খসে গেছে।
আতঙ্কে নবীন জলের মধ্যে চার ধারে হাতড়াতে লাগল। লাঠি! লাঠিটা কোথায়?
মাথার ওপরে ছাদে দুম করে মাথা ঠুকে গেল তার। চোখ পলকের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল। তবু দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সচেতন রাখল সে।
আচমকাই লাঠিটা পেয়ে গেল পায়ের কাছে। চেপে ধরে এগোতে গিয়েই বুঝল, ওরা ভাই-বোন লাঠিটা ছেড়ে দিয়েছে।
হায়হায় করে উঠল নবীনের বুকটা। বাচ্চা দুটো ছেলে-মেয়ে এভাবে বেঘোরে ডুবে গেল? সে কিছু করতে পারল না? নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল তার।
কিন্তু দম শেষ হয়ে আসছে। আর বেশিক্ষণ নয়। এক্ষুনি সে নিজেও ডুবে যাবে, যদি সেও মরে, তবে বাচ্চা দুটোর খোঁজ করবে
নবীন প্রাণপণে তার অসাড় হাত-পা নাড়তে লাগল।
যখন জল থেকে মাথা তুলে খাস নিতে পারল নবীন, তখন তার বুক হাপরের মতো উঠছে পড়ছে।
কিছুক্ষণ কোনও কিছু চিন্তা করতে পারল না নবীন। শুধু হাঁ। করে দম নিল। তার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল তার শ্বাস।
অনু আর বিলু কোন্ অতলে গেল, কে জানে! বিপদ থেকে বাঁচিয়ে এত দূর এনেও শেষরক্ষা হল না? নবীন কনকনে ঠাণ্ডা জলে থেকেও গায়ে শীত টের পাচ্ছে না। বাচ্চা দুটোর জন্য দুঃখে নিজের শরীরের কষ্টও সে ভুলে গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার ডুব দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ক্ষীণ গলার স্বর শুনতে পেল, “নবীনদা!”
“কে, অনু?”
আশায় আনন্দে ব্যাকুল হয়ে নবীন চেঁচাল।
“হ্যাঁ। তুমি কোথায়?”
“এই তো! তোমরা দুজনেই কি আছ একসঙ্গে?”
“হ্যাঁ। আমরা তো তোমার লাঠি ছেড়ে দিয়ে আগে-আগে সাঁতরে চলে এসেছি।”
নবীনের বুক থেকে একটা ভার নেমে গেল। গলার স্বর কোথা থেকে আসছে আন্দাজ করে সে এগিয়ে গেল। অনু আর
বিলু প্রায় দশ বারো হাত এগিয়ে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
অন্ধকারে কেউ কারও মুখ দেখতে পেল না। তিনজনেরই হাঁফ ধরা অবস্থা। বেশি কথা বলা অসম্ভব।
নবীন শুধু বলল, “চলো।”
তিনজন পাশাপাশি সাঁতরাতে লাগল।
বিলু জিজ্ঞেস করল, “নবীনদা, ওরা কি জল পেরিয়ে আমাদের পিছু নিতে পারবে?”
নবীন’বলে, “কিছুই অসম্ভব নয়। তবে ওরা হয়তো আমাদের ফেলে রাখা জামাকাপড় দেখে ভাববে, ভয়ে আমরা জলে ডুবে গেছি, আর জলে-ডোবা সুড়ঙ্গ তো ভীষণ বিপজ্জনক। ওরা হয়তো চট করে এ-পথে আসবে না।”
অনু আর বলু সত্যিই ভাল সাঁতরায়। বেশি জল না ছিটকে, নিঃশব্দে লম্বা জল টেনে দুজনে নবীনের চেয়েও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল।
“এ রকম আর কতক্ষণ সাঁতরাতে হবে, নবীনদা? আমরা কোথায় যাচ্ছি বলে তো?” অনু জিজ্ঞেস করল।
নরীন সখেদে বলে, “কে জানে? জন্ম থেকেই তো কেটেরহাটে আছি, এখানে যে এ রকম সব সুড়ঙ্গ বা মাটির নীচে এ রকম জলে-ডোবা জায়গা আছে, কস্মিনকালেও জানতাম না।”