অনু তার ভাইকে বুকে চেপে ধরে বলল, “কিন্তু আমরা তো ওদের শত্রু নই! যদি চেঁচিয়ে সেকথা ওদের বলা যায়, তা হলে কী হয়?”
নবীন চিন্তিতভাবে বলল, “চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু খুব লাভ হবে বলে মনে হয় না।”
নবীন সুড়ঙ্গের মুখটায় এগিয়ে গেল। তার পর চেঁচিয়ে বলল, “গুলি করবেন না। আমাদের সঙ্গে দুটো বাচ্চা আছে। আমরা বিপদে পড়েছি।”
কিন্তু নবীনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফের কয়েকটা গুলি এসে পাথরের গায়ে বিঁধল। পাথরের কুচি ছিটকে এসে লাগল নবীনের মুখে। সে সভয়ে সরে এল।
বলল, “এরা খুনে।”
বিলু অনুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুই, আমার জন্য ভয় পাচ্ছিস, দিদি? মরলে সবাই মরব। অত ভয় কী? এখানে অনেক পাথর আছে। ওরা ওপরে ওঠার চেষ্টা করলে পাথর ছুঁড়ে মারা যাবে। কিন্তু ওদের গুলিতে আমাদের কিছুই হবে না।”
নবীন টর্চটা অনুর হাতে দিয়ে বলল, “বিলু ঠিকই বলেছে। তবে ওদের ঠেকানোর ভার আমার ওপর। তোমরা দুজনে ঘরটা খুঁজে দ্যাখো, কোথাও বেরোবার পথ পাও কি না।”
নবীন সুড়ঙ্গের মুখটায় ঘাপটি মেরে বসে রইল। হাতে পাথর। এই বিপদের মধ্যেও সে ভাবছিল, কুলদা চক্রবর্তী লোকটা কে? নামটা কখনও শুনেছে বলে তার মনে পড়ছিল না। তবে চাঁপাকুঞ্জের কালীবাড়ির পুরুতরা চক্রবর্তী ছিলেন। তাঁদের কেউ কি?
নবীন শুনতে পেল, সুড়ঙ্গ দিয়ে কয়েকজন লোক বুক-ঘষটে এগিয়ে আসছে। খুবই সন্তর্পণে আসছে, কিন্তু বদ্ধ জায়গায় শব্দ গোপন করা যাচ্ছে না।
নবীন শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল।
টর্চের অত্যন্ত জোরালো আলোয় তলার সুড়ঙ্গটা উদ্ভাসিত হয়ে গেল। একটা লোককে আবছা দেখা গেল, হামাগুড়ি দিয়ে নীচে এসে থেমেছে।
নবীনের হাতের পাথর নির্ভুল লক্ষ্যে ছুটে গিয়ে ঠং করে লাগল লোকটার মাথার টুপিতে। টুপিটা লোহার। লোকটা একটুও না দমে হাতটা উঁচু করে, ধরল। একটা পিস্তলের মুখ দেখতে পেল নবীন। চট করে মাথাটা সরিয়ে নিল সে।
ঝিং করে গুলিটা গিয়ে লাগল ঘরের ছাদে। ঘরটা কি কেঁপে উঠল সেই শব্দে?
তার পর দু পক্ষ চুপচাপ। নবীন টের পাচ্ছিল, তার পিছনে অনু-বিলু সারা ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। টর্চ জ্বেলে পথ খুঁজছে। যদি কোনও ফাটল বা গর্ত নজরে পড়ে।
নবীন সাবধানে আবার মুখটা বাড়াল। যা দেখল, তাতে বুক হিম হয়ে গেল তার। সামনের লোকটা বুক-ঘষটে আরও খানিকটা উঠেছে। কোমর থেকে কী একটা জিনিস খুলে নিয়ে লোকটা হঠাৎ ওপর দিকে ছুঁড়ে মারল।
কিছু বুঝে উঠবার আগেই একটা প্রচণ্ড শব্দ আর আলোর ঝলকানি। গুহাটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল, এবং এত প্রচণ্ড আওয়াজ নবীন কখনও শোনেনি। তার মাথাটা হঠাৎ ঝিম ধরে, কানে তালা লেগে, চোখ অন্ধকার হয়ে গেল। অজস্র পাথরের টুকরো আর ধুলোবালি খসে পড়ল তার ওপর।
নবীন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল কিছুক্ষণের জন্য।
হঠাৎ তাকে নাড়া দিয়ে অনু বলল, “নবীনদা! নবীনদা! শিগগির! পথ পেয়েছি!”
নবীন চোখ খুলল। তার পর ধীরে ধীরে উঠে বসল। উঁকি মেরে দেখল, প্রচুর পাথরের টুকরো আর ধুলোবালি খসে পড়ায় নীচের সুড়ঙ্গটা প্রায় ঢেকে গেছে। লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ধুলো আর ধোঁয়ায় তিনজনই কাঁপছে, চোখে জল।
নবীন উঠল, কিছুক্ষণ সময় পাওয়া যাবে। তবে বেশি নয়। ওরা এই সামান্য বাধা ডিঙিয়ে ঠিকই চলে আসবে।
অনু তার হাত ধরে টেনে নিতে-নিতে বলল, “বোমার শব্দে আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শাপে বর হয়েছে। দেখবে এসো।”
নবীন দেখল, গুহার ডান ধারে পাথরের দেওয়ালে বিশাল চিড় ধরেছে। একটা চৌকো পাথর আলগা হয়ে নড়বড় করছে।
নবীন এবার একটু ভাবল, পাথরটাকে যদি সে সামনের দিকে টেনে সরায়, তা হলে ছিদ্রটা ফের বন্ধ করার উপায় থাকবে না, এবং পাজি লোকগুলো পথের সন্ধান সহজেই পেয়ে যাবে। তাই সে পাথরটাকে ভিতরের দিকে প্রাণপণে ঠেলতে লাগল।
পাথরটা ধীরে-ধীরে সরে যেতে লাগল। মাত্র হাত-খানেক লম্বা এবং চওড়া একটা পথ পাওয়া গেল।
অনু আর বিলু সহজেই গলে গেল ভিতরে। সবশেষে নবীন।
পাথরটাকে আবার জায়গামতো বসিয়ে দিতে সামান্য সময় লাগল নবীনের। টর্চের আলোয় দেখা গেল, একটা লম্বা সরু পথ টানা বহু দূর চলে গেছে।
টর্চের আলো কমে আসছে। বেশিক্ষণ জ্বলবে না। ক্লান্ত পায়ে চুপচাপ তিনজন হাঁটতে লাগল। কোথায় যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।
বিলু শ্রান্ত স্বরে বলল, “নবীনদা, ওরা যদি এই গলিতে ঢুকতে পারে, তা হলে আমাদের তাক করে গুলি চালাতে খুব সুবিধে হবে, তাই না? গলিটায় কোনও বাঁক নেই, উঁচু-নিচু নেই।”
নবীন তা জানে। আর জানে বলেই সে নিজে পিছনে রয়েছে। গুলি যদি আসে, তবে তা তার গায়েই প্রথম বিধবে।
নবীন অভয় দিয়ে বলল, “ওরা নিজেরাও এখন বিপদের মধ্যে আছে। চলো, ওসব কথা ভাববার দরকার নেই। জীবনে সব সময়েই উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা ভাববে।”
কয়েক মিনিট হাঁটবার পর গলিটা হঠাৎ সরু হয়ে গেল। তার পর ঢালুতে নেমে থমকে দাঁড়াতে হল তিনজনকে, সামনে আর রাস্তা নেই। গলিটা ঢালু হয়ে কালো জলের মধ্যে নেমে হারিয়ে গেছে।
বিলু বলল, “এখন?”
অনুও সভয়ে নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “নবীনদা, টর্চটা আর বেশিক্ষণ জ্বলবে না কিন্তু!”
নবীন জানে, বিপদে মাথা গুলিয়ে ফেললে লাভ নেই। এখনই মাথা ঠাণ্ডা রাখার সময়।