বচন আগে-আগে বারান্দায় উঠে এসে বলল, “এই যে এঁরা..”
যে তিনজন তোক সামনে এসে দাঁড়াল, তাদের তিনজনের বয়সই ত্রিশের কাছে-পিঠে। বেশ শক্ত-সমর্থ চেহারা। একজনের গায়ে কালো চামড়ার একটা জ্যাকেট, একজনের গায়ে গাঢ় হলুদ পুল-ওভার, তৃতীয়জনের পরনে নেভি ব্লু স্যুট।
তৃতীয়জনকেই নজরে পড়ে বেশি। বেশ লম্বা, সুঠাম চেহারা, মুখে বুদ্ধির ধার এবং ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। কোনও হেঁ হেঁ-ভাব নেই। মনে হচ্ছিল, এ-ই পালের গোদা।
প্রথম কথাও সে-ই বলল, “নমস্কার। আমরা একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি।”
সদাশিববাবু বিনয়ী লোক পছন্দ করেন। এ-লোকটার গলায় অবশ্য বিনয় নেই, স্পর্ধাও নেই। কাজের লোক।
সদাশিববাবু বললেন, “বসুন।” তিনজন তিনখানা বেতের চেয়ারে বসল। সদাশিববাবু খুব কূটচক্ষে তাদের ভাবভঙ্গি লক্ষ করছিলেন। না, কোনও জড়তা নেই, কাঁচামাচু ভাব নেই, বিগলিত ভঙ্গি নেই। পা ছড়িয়ে দিব্যি আরামের ভঙ্গিতেই বসল।
লিডার লোকটা বলল, “যা বলছিলাম..”।
সদাশিববাবু ভ্রূ কুঁচকে বন্দুকের আওয়াজে বললেন, “নাম?”
“ওঃ, হ্যাঁ,” বলে লোকটা একটু হাসল, “আমার নাম অভিজিৎ আচার্য। আমি একজন সায়েন্টিস্ট। আর এঁরা হলেন…”।
সদাশিববাবু আবার বন্দুকের আওয়াজ ছাড়লেন। “সায়েন্স মানে কী? ফিজিক্স না কেমিস্ট্রি? না…”
অভিজিৎ চমকাল না। মৃদুস্বরে বলল, “সে-প্রসঙ্গ অপ্রয়োজনীয়। তবু বলছি, আমার বিষয় হল, এনটেমোলজি। পোকা-মাকড় নিয়ে..”
সদাশিববাবু মাথা নেড়ে বললেন, “জানি। আর এঁরা?”
“এঁরা আমার সহকর্মী। সুহাস দাস আর সুদর্শন বসু।”
“এবার প্রয়োজনটার কথা বলুন।”
অভিজিৎ দুই সঙ্গীর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে সদাশিববাবুর দিকে চেয়ে বলল, “বড় ঝিলের ধারে আপনার একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িটা আমরা কিছু দিনের জন্য ভাড়া নিতে চাই।”
সদাশিববাবু খুবই অবাক হলেন। বললেন, “ঝিলের ধারের বাড়ি ভাড়া নেবেন? বলেন কী?”
“আমরা একটু রিসার্চ করতে চাই। একটা ভাল স্পট বহুদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। এরকম সুটেবল স্পট আর দেখিনি।”
সদাশিববাবুর টাকার অভাব নেই। পৈতৃক সম্পত্তির সূত্রে তাঁর জমানো টাকা বিস্তর। বিষয়-সম্পত্তিও বড় কম নেই। তিনি জীবনে বাড়িতে ভাড়াটে বসাননি। সুতরাং মাথা নেড়ে বললেন, “ভাড়া-টাড়া আমি কাউকে দিই না। ও-সব হবে না। তবে রিসার্চের কাজ হলে দু-চার দিন আপনারা এমনিতেই এসে থাকতে পারেন।”
অভিজিৎ চেয়ারটা একটু সামনে টেনে আনল, তার পর বলল, “রিসার্চের কাজ এক-দু দিনে তো কিছুই হয় না। মাসের পর মাস লেগে যায়। আরও একটা কথা হল, কাজটা একটু অ্যাডভান্সড স্টেজের এবং খুবই গোপনীয়। সেই জন্যই আমরা এরকম একটা রিমোট জায়গা খুঁজে বের করেছি। এ-কাজে একটা খুব বড় সংস্থা আমাদের টাকা দিচ্ছে। ভাড়াও তারাই দেবে।”
সদাশিববাবু একদৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়েছিলেন। বললেন, “কাজটা অ্যাডভান্সড স্টেজের এবং গোপনীয় বলছেন? কী রকম কাজ, তা বলতে বাধা আছে?”
অভিজিৎ একটু ভাবল। তার পর বলল, “শুধু বাধা নয়, বিপদও আছে।”
সদাশিববাবুর ভূ ওপরে উঠে গেল। তিনি তীক্ষ্ণ চোখে আগন্তুককে লক্ষ করে বললেন, “বিপদ! রিসার্চ ওয়ার্কে আবার বিপদ কিসের?”
অভিজিৎ নিজের দুই সঙ্গীর সঙ্গে একটা গোপন অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে নিয়ে বলল, “সব কথা খুলে বলতে পারছি না বলে আমাকে মাফ করবেন। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমাদের কাজে যদি আমরা সফল হই, তবে দেশের উপকার হবে।”
সদাশিববাবু একটু হাসলেন। তার পর বললেন, “আমার বয়স কত জানেন?”
“জানি। সাতাত্তর। আপনি ছ’ ফুট এক ইঞ্চি লম্বা। ওজন বিরাশি কেজি। আপনি ইংরেজি অনার্স আর এম. এ.-তে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। এক সময়ে দুর্দান্ত স্পোর্টসম্যান ছিলেন। টেনিসে ছিলেন ইন্ডিয়া নাম্বার থ্রি। ফ্রি রাইফেল শুটিং-এ ছিলেন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন। ভাল ক্ল্যাসিক্যাল গান গাইতে পারতেন। শিকারি ছিলেন। আরও বলতে হবে কি?”
সদাশিব এত অবাক হয়ে গেলেন যে, কয়েক সেকেন্ড কথা এল না মুখে। তার পর সোজা হয়ে বসে বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও ছোঁকরা। তুমি তো ডেঞ্জারাস লোক হে! অ্যাঁ! এত খবর তোমাকে দিল কে?”
অভিজিৎ মৃদু-মৃদু হাসছিল। বলল, “আপনার সম্পর্কে যা কিছু জানি, সেগুলো লোকের মুখে শোনা। আর লোকেরা শুনেছে। আপনারই মুখে।”
“তার মানে?”
“সদাশিববাবু, বয়স হলে মানুষ তার অতীতের কথা লোককে বলতে ভালবাসে। আপনিও ব্যতিক্রম নন। এই কেটেরহাটের লোকেরা আপনার সেই স্মৃতিকথা শুনে-শুনে মুখস্থ করে ফেলেছে। আমরা আপনার বাড়িটার খোঁজে এসে আপনার সম্পর্কেও অনেক কথা তাদের মুখেই শুনেছি।”
সদাশিববাবু একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন, “তাই বলো। আমি ভাবলাম বুঝি পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছ।”
সদাশিববাবু নিজেও টের পাননি, কখন তিনি অভিজিৎকে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছেন।
অভিজিৎ মাথা নেড়ে বলল, “না, গোয়েন্দা লাগানোর তো কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু বয়সের কথাটা কেন বলছিলেন তা বুঝতে পারিনি।”
সদাশিববাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঃ। বয়সের কথাটা বলছিলাম তোমাদের লম্বা-চওড়া কথা শুনে। বাঙালিরা হচ্ছে ভেত, গেতো আর তেতো। তাদের দিয়ে বড় কাজ হওয়ার কোনও আশাই আর নেই। তা, তোমরা এমন কী সাঙ্ঘাতিক কাজ করছ হে বাপু, যাতে দেশের উপকার হবে। আবার নাকি তাতে বিপদও আছে! আবার নাকি সেটা খুব টপ সিক্রেট!”