বিলু হাততালি দিয়ে চেঁচাল, “হুঁররে!” বিলুর চিৎকারের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আচমকা ওপরে ইদারার মুখ থেকে একটা ভীষণ শব্দ এল। দুম। ইদারার পরিসরে এবং গভীরে সেই শব্দ বোমার মতো ফেটে পড়ল। আর সেই সঙ্গে একটা আগুনের ফুলকির মতো কী একটা যেন ঝিং করে এসে বিধল ইদারার পাথরে।
তিনজনেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনায়।
অনু বলল, “কেউ আমাদের তাক করে গুলি চালিয়েছে।” কথাটা শেষ হতে-না-হতেই ওপর থেকে পর পর কয়েকটা গুলির শব্দ হল! লতাপাতা ভেদ করে বিদ্যুৎ-গতিতে কয়েকটা বুলেট কাদায় গেঁথে গেল।
নবীন হ্যাঁচকা টানে অনু আর বিলুকে টেনে নিয়ে গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “পালাও, ওরা নেমে আসছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের পালাতে হবে।”
তিনজনে গর্তের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল। অনু টর্চ নিয়ে আগে-আগে। তার পর বিলু, সব শেষে নবীন।
নবীন বলল, “গর্তের মুখটা খোলা রইল। ওরা আমাদের সন্ধান ঠিকই পেয়ে যাবে।”
বিলু অবাক, গলায় বলল, “ওরা কারা নবীনদা? গুলি করছে কেন?”
নবীন চাপা গলায় বলল, “বুঝতে পারছি না। গতকাল এরাই বোধহয় সিদ্ধিনাথ আর ভুজঙ্গকে মেরেছিল। ওদের প্রাণে মারেনি, কিন্তু আমাদের হয়তো প্রাণে মারবে।”
“কেন নবীনদা? আমরা কী করেছি?”
“হয়তো না-জেনে এমন কিছু করে ফেলেছি, যাতে ওদের স্বার্থে ভীষণ ঘা লেগেছে।”
সুড়ঙ্গ-পথে হামাগুড়ি দিয়ে এখোনো মোটেই সহজ কাজ নয়। সুড়ঙ্গটা ভীষণ নোংরা। চোখে-মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে যাচ্ছে। হাত-পায়ের ওপর দিয়ে ইঁদুর আর ছুঁচো দৌড়ে যাচ্ছে বার বার। নীচে নুড়ি পাথরে বার বার হড়কে যাচ্ছে হাঁটু। ছড়ে কেটে যাচ্ছে হাতের তেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনজনেই হাঁপিয়ে পড়ল।
অনু জিজ্ঞেস করল, “একটু বসব নবীনদা?” নবীন তাড়া দিয়ে বলল, “বিশ্রাম পরে হবে। এখন প্রাণ বাঁচানোটা আগে দরকার।”
অনু সখেদে বলল, “নীচে পড়বার সময় আমার বন্দুকটা যে কোথায় ছিটকে পড়ল, কে জানে! বোধহয় কাদার মধ্যে তলিয়ে গেছে। বন্দুকটা থাকলে জবাব দিতে পারতাম।”
নবীন বলল, “বন্দুক থেকেও লাভ ছিল না। ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এক্সপার্ট। চলো, এগোও।”
আবার তিনজনে হামাগুড়ি দিয়ে বদ্ধ গুহার মধ্যে এগোতে লাগল। চার দিকে সঁতসেঁতে। বাতাসে কেমন একটা গুমোট। পচা গন্ধও নাকে আসছে। মরা ইঁদুরই হবে।
টর্চের আলোয় দেখা গেল, ক্রমেই সুড়ঙ্গটা ওপরে উঠছে। চড়াইতে উঠতে গিয়ে বিলু হড়কে গড়িয়ে পড়ল নীচে। তার ধাক্কায় অনু আর নবীনও। কিন্তু তার পরই ধুলো ঝেড়ে আবার উঠতে লাগল ওপরে।
পালাতেই হবে। পালাতেই হবে। চড়াইটা পার হয়ে ওপরে উঠতেই তিনজন অবাক।
৮. একটা মস্ত ঘরের মধ্যে
একটা মস্ত ঘরের মধ্যে তারা দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ঘর বললে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। পাথরের এবড়ো-খেবড়ো দেওয়াল, নীচেও নুড়ি-পাথর ছড়ানো। ঘরের মধ্যে বোধহয় দুশো বছরের বদ্ধ বাতাসের সোঁদা গন্ধ। টর্চের আলোয় যত দূর দেখা গেল, এখান থেকে বেরোনোর কোনও রাস্তা নেই।
অনু বলল, “নবীনদা, এবার কী করবে? এ তো দেখছি অন্ধকূপ!”
নবীন একটু চিন্তিতভাবে বলল, “চিন্তা করো না, উপায় একটা হবেই।”
শীতে-জলে কাদায় মাখামাখি হওয়ায় তিনজনেরই অবস্থা করুণ। তার ওপর পরিশ্রম বড় কম যায়নি।
নবীন টর্চটা ফেলে চার দিক ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। নিরেট পাথর, কোথাও ফাঁক-ফোঁকর তার নজরে পড়ল না।
নবীনের শেষ ভরসা সেই অশরীরীর কণ্ঠস্বর। কিন্তু গুহায় ঢুকবার পর থেকেই সে আর স্বরটা শুনছে না। তবে নবীনের স্থির বিশ্বাস, কণ্ঠস্বরটা তার ঠাকুরদার। সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অনু আর বিলুর কাছ থেকে যত দূর সম্ভব দূরে সরে গিয়ে ঘরের একেবারে কোণে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, “দাদু! প্রম্পট করছ কেন বলো তো?” জবাব নেই।
“বলি, ও ঠাকুরদা, তোমার হলটা কী?”
তবু জবাব নেই।
হতাশ গলায় নবীন বলল, “বলি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি, দাদু?”
হঠাৎ গলার স্বরটা শোনা গেল। কানের কাছে কে যেন খিঁচিয়ে উঠে বলল, “আমি তোর দাদু কোন সুবাদে রে বাঁদর? কুলদা চক্কোত্তির নাতি হলে কি তুই এত গবেট হতিস? যা, জাহান্নমে যা।”
বিল হঠাৎ হেসে উঠে বলল, “ও নবীনদা, তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ?”
নবীন কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “কারও সঙ্গে নয়, এই আপনমনেই একটু কথা বলছিলাম আর কি! যাকে বলে থিংকিং অ্যালাউড।”
“মাটির নীচে এই ঘরটা কারা বানিয়েছিল নবীনদা?”
“জানি না ভাই, তবে আমাদের পূর্বপুরুষেরাই কেউ হবে।”
“কেন বানিয়েছিল, তা বুঝতে পারছ? গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু কোথাও তো ঘড়া বা কলসি দেখছি না।”
নবীন পায়ের নীচের নুড়ি-পাথরগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। সময় যে হাতে বেশি নেই, তা সে ভালই জানে। একটা বড় চ্যাটালো পাথর সরিয়ে তলাটা পরীক্ষা করতে করতে সে বলল, “গুপ্তধনের দরকার নেই ভাই, এখন এখান থেকে সরে পড়াটাই বেশি দরকার।”
এমন সময় হঠাৎ নীচের সুড়ঙ্গে পর পর কয়েকটা গুলি চালানোর শব্দ হল। আর সেই শব্দটা এই বদ্ধ ঘরে এত জোরে ফেটে পড়ল যে, তিনজনেই ভীষণ চমকে উঠে কানে হাত চাপা দিল।
বারুদেরপোড়া গন্ধে ঘরটা ভরে যাচ্ছিল ধীরে-ধীরে। নবীন হতাশ গলায় বলল, “ওরা নেমে এসেছে।”