দু’জনে এগোতে লাগল। এবং কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারল, তাদের পায়ের নীচের কুঁড়ি-পথটা আর নেই। তারা ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে বিপথে এসে পড়েছে।
অনু টর্চটা জ্বালাল, তার পর বলল, “আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।”
“চল, ফিরে যাই।”
“ফিরে যাওয়ার পথটাও তো খুঁজতে হবে। তার চেয়ে চল, এগোতে থাকি। এক সময়ে জঙ্গল শেষ হয়ে যাবে।”
“চল।”
দু’জনে সম্পূর্ণ আন্দাজে হাঁটতে লাগল। পায়ের নীচে লতা-পাতা, চার দিকে ঝোঁপঝাড়, মাঝে-মধ্যে বাঁশবন, বড়-বড় গাছের জড়াজড়ি।
“কোথায় যাচ্ছি রে দিদি?”
“চল না?”
“জঙ্গলটা কত বড়?”
“বেশ বড় বলেই শুনেছি। সুন্দরবনে গিয়ে মিশেছে।”
“ও বাবা!”
অনু পিঠ থেকে বন্দুকটা খুলে হাতে নিল। তার পর বলল, “ভিতু কোথাকার! তোকে না-আনলেই হত।”
“মোটেই ভয় পাইনি। চল না! আমার পকেটে গুলতি আছে।”
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে যত এগোচ্ছে, তো জঙ্গল গভীর আর ঘন হচ্ছে। ঘাস-ঝোঁপ প্রায় বুক-সমান উঁচু। লতা-পাতায় বারবার পা আটকাচ্ছে। দুবার পড়ে গেল বিলু। তেমন চোট লাগল না অবশ্য। অনু পড়ল একবার।
“দিদি, খরগোশ না?”
“খরগোশ আছে, শেয়াল আছে, শজারু আছে। ওগুলো কিছু করবে না।”
“জানি।”
ক্রমে-ক্রমে চলাটাই অসম্ভব হয়ে পড়তে লাগল। এতক্ষণ কাঁটাঝোঁপের বাড়াবাড়ি ছিল না। কিন্তু এবার কাঁটাঝোঁপ পথ আটকাতে লাগল।
দু’জনের গায়েই পুরু গরমজামা আর মাথায় কান-ঢাকা টুপি থাকায় তেমন আঁচড় লাগেনি, কিন্তু এগোতে বাধা হচ্ছিল।
“কী করবি দিদি?”
অনু তার ওভারকোটের পকেট থেকে একটা বড় ফোল্ডিং ছুরি বের করে তাই দিয়ে সামনের পথ পরিষ্কার করতে করতে বলল, “এগিয়ে যাব।”
“কিন্তু কালীবাড়ি?”
“দেখাই যাক না।” ঘাসবন ক্রমে উঁচু হতে-হতে তাদের মাথা ছাড়িয়ে গেল। কাঁটাঝোঁপ এত নিবিড় হল যে, আর এগোনোই যায় না। এদিকে বিলুর ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছে। একটু খিদেও পাচ্ছে।
“দিদি?”
অনু দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যারা নতুন দেশ আবিষ্কার করেছে, যারা বড় বড় পাহাড়ে উঠেছে, যারা মরুভূমি পার হয়, যারা যুদ্ধ করে, তারা এর চেয়েও লক্ষ গুণ বেশি কষ্ট করে, তা
জানিস।”
“জানি।”
“ভয় নেই, আমি যতক্ষণ সঙ্গে আছি, ততক্ষণ কেউ তোর কিছু করতে পারবে না। খিদে-তেষ্টা একটু সহ্য কর।”
“রাত বাড়লে যে ঘুম পাবে।”
“তখন আমার কোলে শুয়ে ঘুমোস।”
“হুঁ! তোর কোলে শোব কেন? আমি কি কচি খোকা?”
“তা হলে কচি খোকার মতো তেষ্টা পেয়েছে, খিদে পেয়েছে করছিস কেন? আমার তো পথ হারিয়ে বেশ মজাই লাগছে। কলকাতায় কি এ রকম অ্যাডভেঞ্চার হয়?”
বিলু সভয়ে চার দিক চেয়ে দেখল। এখানে জঙ্গল এত নিবিড় যে, আকাশ একটুও দেখা যায় না। চারদিকে ভুতুড়ে নির্জনতা। টর্চের আলো ছাড়া এগোনো অসম্ভব। কিন্তু টর্চের আলো ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। এর মধ্যেই আলোটা লাল আর ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে।
অনু হঠাৎ বলল, “অনেকক্ষণ হেঁটেছি। আয়, দুজনে বসে একটু জিরিয়ে নিই।”
এ কথায় বিলু খুশি হল। তার আর এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না। অন্ধকারেই সে টের পাচ্ছিল, হাতের দস্তানা ছিঁড়ে গেছে কাঁটায়, আঙুলও ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছে। গায়ে আঁচড় লেগেছে।
“কোথায় বসবি?”
“ওই যে গাছটা দেখা যাচ্ছে, আয়, ওর তলায় বসি।”
মস্ত গাছ। টর্চের আলো ফেলে অনু দেখল, বটগাছ। চার দিকে অজস্র ঝুরি নেমে গাছটা নিজেই জঙ্গল হয়ে আছে।
দুজনে ধীরে ধীরে গাছটার কাছে এগোতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, গাছটার চারধারে ঝোঁপঝাড় বিশেষ নেই।
অনু টর্চ জ্বেলে অবাক হয়ে দেখল, বটগাছের তলাটায় তো জঙ্গল নেই, আর মূল কাণ্ডের চারদিকটা বড়বড় চৌকো পাথর দিয়ে বাঁধানো।
অনু বলল, “বাঃ, এখানে শোওয়াও যাবে রে।”
বিলু পাথরের ওপর শোওয়ার প্রস্তাবে তেমন খুশি হল না। কিন্তু একটু বসতে পাবে, এটাই যা আনন্দের কথা।
দু’জনে পাথরের বেদীতে পাশাপাশি বসল। অনু টর্চ জ্বেলে চারদিকটা দেখতে লাগল।
“এ জায়গাটা কী ছিল বল তো বিল?”
“জানি না তো?”
“আন্দাজ করতে পারিস না?”
“না। খিদে পেলে আমার মাথাটা একদম কাজ করতে চায় না।”
অনু উঠে চার দিকটায় আলো ফেলে ঘুরে-ঘুরে দেখল। তার পর বিলুর পাশে এসে বসে বলল, “এখানে বহুকাল আগে লোকের আনাগোনা ছিল। একটা মস্ত ইদারার মুখ দেখলাম! তাতে আবার সিঁড়ি লাগানো। মনে হয়, ওটা ফাঁসি দেওয়ার কুয়ো।”
বিলু ভয় খেয়ে বলল, “ফাঁসি?”
অনু মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা ডাকাত ছিল জানিস তো! দাদুর কাছে শুনেছি, তারা বিশ্বাসঘাতকদের ধরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বিচার করত। তার পর ফাঁসি দিত।”
বিলু বলল, “ও বাবা!”
অনু আর বিলু খানিকক্ষণ জিরোল। তার পর অনু বলল, “এভাবে রাতটা কাটিয়ে দিবি নাকি রে, বিলু?”
“একটু ভয়-ভয় করছে রে, দিদি।”
“তা হলে আয়, চার দিকটা ভাল করে দেখি। ওই কুয়োটা আমার আর-একটু ভাল করে দেখার ইচ্ছে।”
“তোর সাঙ্ঘাতিক সাহস!”
“বিপদে না পড়লে মানুষের সাহস হয় না। আমার সব ভয়-ডর কেটে গেছে। আয় আমার সঙ্গে।
“কুয়োর মধ্যে কী আছে?”
“জানি না। তবে ভিতরে কুয়োর গা বেয়ে অনেক দূর পর্যন্ত সিঁড়ি নেমে গেছে। কেন, তা দেখতে হবে।”
অনুর পিছু পিছু বিলু এগোতে লাগল। ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে খানিকটা এগোতেই কুয়োটা দেখা গেল। এই জায়গায় বহুকাল লোকজন আসেনি, বোঝাই যায়। ইটে বাঁধানো কুয়োটা বেশ খানিকটা উঁচু। কুয়োর ওপর এক সময়ে হয়তো ফাঁসির মঞ্চ ছিল। দু ধারে দুটো ভাঙা থাম আজও দাঁড়িয়ে আছে। কুয়োর ধারে উঠবার সিঁড়িও আছে। তবে তা ভাঙাচোরা।