বিকেলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানল, সিদ্ধিনাথ ঘুমোচ্ছে। একটু ভালর দিকে।
নবীন লাইব্রেরিতে গিয়ে খানিকক্ষণ বই-পত্র নাড়াচাড়া করল। উঠতে যাবে, এমন সময় বিলু এসে হাজির।
“নবীনদা!”
“আরে, বিলু!”
“তোমাকেই খুঁজছি কখন থেকে। চলো, কথা আছে।”
“কী কথা?”
“চলো না, বাইরে দিদি দাঁড়িয়ে আছে।”
নবীন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। “কী ব্যাপার বলো তো?”
অনু বলল, “নবীনদা, আমরা জঙ্গলের মধ্যে যাব। তোমার সঙ্গে।”
“এই রাত্রে?”
“রাতেই তো যা ঘটবার ঘটে।”
“কিন্তু সদাশিববাবু শুনলে যে রাগ করবেন।”
“করবেন না। আমরা যাত্রা শুনবার নাম করে বেরিয়েছি। ভুজঙ্গদা সঙ্গে যাবে।”
নবীন তবু দোনোমোনো করে বলল, “ও জায়গাটা ভাল নয় যে! তোমরা ছেলেমানুষ। যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
অনু তার গায়ের ওভারকোটটা খুলে পিঠ থেকে স্লিং-এ ঝোলানো একটা বন্দুক বের করে বলল, “দেখেছ? আমি বন্দুক ভালই চালাতে পারি। আমি কাউকে ভয়ও পাই না। তবে বিলুটা একটু ভিতু।”
বিলু সঙ্গে-সঙ্গে দিদির হাত খিমচে ধরে বলল, “আরশোলা দেখে তোর মতো কি আমি চেঁচাই?”
নবীন বন্দুক দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। অনু বাচ্চা মেয়ে, তার কাছে বন্দুক থাকাটা সমীচীন নয়। সদাশিববাবু যদি জানতে পারেন যে, এই ঘটনাকে নবীন প্রশ্রয় দিয়েছে, তা হলে ভীষণ রেগে যাবেন।
নবীন তাই ভালমানুষের মতো বলল, “জঙ্গলে আজ রাতে গিয়ে লাভও হবে না। পুলিশ সেখানে গিজগিজ করছে। একটু আগে আমাদের মহাদেব দেখে এসেছে কিনা। সারা জঙ্গল বড়-বড় লাইট ফেলে তল্লাসি হচ্ছে। বাইরের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।”
সর্বৈব মিথ্যে কথা। তবে কাজ হল। একথায় ভাই-বোন একটু মুষড়ে পড়ল। রহস্যময় নৈশ অভিযান তা হলে তো সম্ভব নয়।
নবীন বলল, “আজ বাড়ি গিয়ে চুপটি করে থাকে। কাল জঙ্গলে যাওয়া যাবে।”
অনু আর বিলু হতাশ গলায় বলল, “আচ্ছা।”
নবীন দু’জনকে বাড়ির পথে খানিকদূর এগিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
নবীনের মাথাটা বড্ড এলোমেলো। অল্প সময়ের মধ্যে এত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সে ঠিক তাল রাখতে পারছে না। কিন্তু কেটেরহাটের নিস্তরঙ্গ জীবনে যে হঠাৎ একটা বড় রকমের ঘটনা ঘটতে চলেছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
নবীন তাদের এগিয়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার পরই বিলু আর অনু দাঁড়িয়ে পড়ল।
অনু বলল, “দ্যাখ বিলু, আমার মনে হল, নবীনদা আমাদের ভাগিয়ে দেওয়ার জন্যই পুলিশের কথাটা বানিয়ে বলল।”
“আমারও ঠিক তাই মনে হচ্ছে রে দিদি। বড়রা তো এ রকমই হয়, ছোটদের পাত্তা দিতে চায় না।”
“তা হলে আমাদের কী করা উচিত? নবীনদাকে বাদ দিয়েই যাব কি না ভাবছি। শুধু ভুজঙ্গদা সঙ্গে থাকবে।”
বিলু মাথা নেড়ে বলল, “ভুজঙ্গদা রাজি হয়েছে বটে, কিন্তু শেষ অবধি ভুজুং-ভাজাং দিয়ে যাওয়া আটকে দেবে।”
অনু একটু ভেবে নিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস। ভুজঙ্গদা কেমন যেন ‘আচ্ছা-আচ্ছা-হবে-হবে’ বলে এড়ানোর চেষ্টা করছিল। তা হলে কী করা উচিত?
“তুই আর আমি মিলে যাই, চল।”
“তোর ভয় করবে না তো?”
“না। আমাদের তো বন্দুক আছে। ভয় কী?”
অনু রাস্তাটা ভাল করে দেখে নিল। কেউ নেই। কেটেরহাটে এমনিতেই লোকজন কম। তার ওপর এবারকার সাঙ্ঘাতিক, শীতে বিকেলের পর আর রাস্তা-ঘাটে বিশেষ লোক থাকে না।
অনু বলল, “তা হলে চল।” দুই ভাই-বোন অতি দ্রুত আবার উলটো দিকে হাঁটতে লাগল। একটু বাদেই ঝিলের ধার ঘেঁষে তারা জঙ্গলের পথে পা দিল।
“দিদি! বাঘটা তো আসল বাঘ নয়! না?”
“না।”
“ঠিক তো?”
“তাই তো ভুজঙ্গদা বলছে। ভুজঙ্গদা সাকাসে ছিল, বাঘের ডাক ভালই চেনে। তোর কি ভয় করছে?”
“না তো! ভয় কী? বন্দুক আছে না?”
অনু একটু হেসে বিলুর হাতটা চেপে ধরে বলল, “বাঘ হলেই বা কী? আমি ভয় পাই না।”
“আমিও না।”
জঙ্গলের মধ্যে নিবিড় অন্ধকার। ঢুকবার আগে দু’জনে একটু দাঁড়াল। পরস্পরের দিকে একটু তাকাল। তার পর দু’জনে দু’জনের হাত ধরে ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকল।
প্রথমটায় পথ দেখা যাচ্ছিল না। মাঝে-মাঝে টর্চ জ্বালতে হচ্ছিল।
অনু বলল, “টর্চ জ্বালাটা ভাল হচ্ছে না। যদি পাজি লোক কেউ থেকে থাকে এখানে, তবে সে টের পেয়ে যাবে।”
“অন্ধকারে কী করে হাঁটবি?”
“একটু দাঁড়িয়ে থাকলে ধীরে-ধীরে চোখে অন্ধকার সয়ে যাবে।”
দু’জনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। ক্রমে-ক্রমে চার দিককার নিবিড় জঙ্গল তাদের চোখে আবছা ফুটে উঠতে লাগল।
“এবার চল।”
অনু আর বিলু এগোতে লাগল। হঠাৎ বিলু চাপা গলায় বলল, “দিদি!”
“কী রে?”
“কিছু দেখলি?”
“না তো! তুই দেখলি?”
“বাঁশবনের মধ্যে একটা ছায়া সরে গেল যেন!”
“ও কিছু নয়, শেয়াল।”
মুখে ‘শেয়াল’ বললেও অনু চার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কী তারা খুঁজতে বা জানতে এসেছে, তা তারা নিজেরাও ভাল জানে না।
অনু ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “কালীবাড়ি আর বেশি দূরে নয়। সাবধানে আয়। কোনও শব্দ করিস না।”
আরও মিনিট কয়েক নিঃশব্দে হাঁটার পর অনু বলল, “দাঁড়া।”
“কেন রে দিদি?”
“মনে হচ্ছে অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।”
“তা হলে কী হবে?”
অনু বলল, “ভয় পাস না। বিপদে ভয় পেলে বিপদ আরও বাড়ে। চল এগোই। রাস্তা ঠিক পেয়ে যাব।”
অনু তার কবজির ঘড়িটা দেখল। উজ্জ্বল ডায়াল, অন্ধকারেও সময় বুঝতে অসুবিধে নেই। রাত মোটে পৌনে ন’টা বাজে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে মনে হচ্ছে নিশুত রাত।