দশ মিনিটের মধ্যেই ভুজঙ্গ চোখ মেলে চাইল।
“ভুজঙ্গদা।”
“কে?”
“আমি নবীন। এখন কেমন লাগছে?”
ভুজঙ্গ যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করে বলল, “আমাকে ধরে তোলে। তো।”
“চলতে পারবে?”
“পারব।” নবীন তাকে ধরে বসাল। “কী হয়েছিল ভুজঙ্গদা?”
ভুজঙ্গ ঠোঁট উল্টে বলল, “কী করে বলব? সিদ্ধিনাথকে পাহারা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ কাছে-পিঠে একটা বাঘ ডেকে উঠল। প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সাকাসে মেলা বাঘ-সিংহ দেখেছি, দিন রাত তাদের ডাক শুনেছি। কেমন যেন মনে হল, এ সাচ্চা বাঘের ডাক নয়।”
“বটে! তোমারও তাই মনে হল?”
“তুমিও শুনেছ নাকি?”
“শুনেছি, আমারও মনে হয়েছে, ওটা আসল বাঘের ডাক নয়। তোমার ঘটনাটা আগে বলো।”
“বাঘের ডাকটা নকল বলে মনে হতেই আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। চার দিক সুনসান। হঠাৎ শুনলাম, ঝোঁপঝাড় ভেঙে কে যেন চলে যাচ্ছে। মনে হল, একটা বেশ লম্বা চেহারার লোক বাঁশবনের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পিছু নিলাম। লোকটাকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবছি, কোন দিকে যাব–হঠাৎ আবার সেই বাঘের ডাক। এই দিক থেকেই হল। দৌড়ে এলাম। তখন আচমকা কে যে পিছন থেকে মাথায় মারল, কিছু বুঝতে পারলাম না।”
নবীন চিন্তিতভাবে বলল, “তোমার কিছু সন্দেহ হয়?”
ভুজঙ্গ মাথা নেড়ে বলল, “শুধু মনে হচ্ছে কোনও পাজি লোক কেটেরহাটে এসে জুটেছে। সিদ্ধিনাথকে নইলে মারবে কে, বলো? তার টাকা-পয়সা নেই, সম্পত্তি নেই।”
নবীন একটু হেসে বলল, “তা না থাক, তবে সিদ্ধিনাথ হয়তো গুপ্ত কোনও খবর রাখে, যা আমি বা তুমি জানি না।”
“কী জানি বাপু!”
“তুমি হাঁটতে পারবে ভুজঙ্গদা?”
“পারব।”
“তা হলে আমার কাঁধে ভর দিয়ে চলো। অনেকটা পথ।”
“পারব হে নবীন। ভুজঙ্গ সাকাসে খেলা দেখাত। সে ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায় না।”
দু’জনে এগোতে লাগল।
৬. ভোর রাতে সিদ্ধিনাথের খুব জ্বর এল
ভোর রাতে সিদ্ধিনাথের খুব জ্বর এল। সে ভুল বকতে শুরু করল।
হেলথ সেন্টারে চিকিৎসার ব্যবস্থা খুব ভাল নয়। তবে ডাক্তার লোক ভাল। নিজের ঘর থেকে ওষুধপত্র এনে দিলেন। কেটেরহাটের মেলা-লোক রাত জেগে বসে রইল বাইরে, এই সাঙ্ঘাতিক শীতের মধ্যেও।
ভোরবেলা ডাক্তার এসে নবীনকে বললেন, “সিদ্ধিনাথের অবস্থা ভাল নয়। বিকারের মধ্যে সে কিছু বলছে। কথাগুলো আপনি এসে একটু শুনুন।”
নবীন গিয়ে দেখল, সিদ্ধিনাথ চিত হয়ে পড়ে আছে। মুখখানা নীলবর্ণ। মাঝে-মাঝে অস্ফুট ‘উঃ আঃ’ করছে। মাঝে-মাঝে কথা। বলে উঠছে।
নবীন কাছেই একটা চেয়ার টেনে বসল।
সিদ্ধিনাথ খানিকক্ষণ নিঝুম হয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, “নবীনের বাড়ির পশ্চিম কোণ…কালীবাড়ির দক্ষিণে..ওঃ, কী অন্ধকার! বাঘ ডাকছে…বাবা রে! …ওরা কারা? ..যাটটা সিঁড়ি আছে.. সদাশিবকতাকে বলো, এরা ভাল লোক নয়..”
নবীন কিছুই বুঝতে পারল না। তবে কথাগুলো মনে রাখল। সিদ্ধিনাথ ফের বলল, “পাতালঘর…নবীনের পাতালঘর..কেউ ঢুকতে পারবে না…”
নবীন পাতালঘরের কথায় সিদ্ধিনাথের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল।
“সিদ্ধিনাথ খুড়ো! কী বলছ?”
সিদ্ধিনাথ আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
নবীন ডাক্তারের দিকে চেয়ে বলল, “কী মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবু? বাঁচবে?”
“বাঁচতে পারে। তবে বাহাত্তর ঘন্টার আগে কিছু বলা যায় না। শুনছি, সদাশিববাবু কলকাতা থেকে ডাক্তার আনাবেন, দেখা যাক, তারা যদি কিছু করতে পারে।”
“কী করে আনাবে?”
“সদাশিববাবুর ঝিলের বাড়িতে কারা ভাড়া এসেছে। তাদের গাড়ি আছে। একজন সেই গাড়ি নিয়ে কলকাতা রওনা হয়ে গেছে।”
নবীন শুনে নিশ্চিন্ত হল।
বেলা আটটা নাগাদ কলকাতার ডাক্তার, ওষুধপত্র, অক্সিজেন সিলিন্ডার, সবই চলে এল। কেটেরহাটের লোকেরা ধন্য-ধন্য করতে লাগল। চাকরবাকরের জন্য মনিবেরা তো এত করে না। সদাশিববাবু নিজেই ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে এলেন।
নবীনের দিকে চেয়ে সদাশিব বললেন, “বুঝলে নবীন, সিদ্ধিনাথ আমাদের পরিবারে আছে এইটুকু বয়স থেকে। তার জন্য দু-চার-পাঁচ শো টাকা খরচ করাটা কোনও বিরাট মহত্ত্ব নয়।”
নবীন মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে। তবে সিদ্ধিনাথের কিছু গোপন খবরও জানা আছে। সেটা বেশ মূল্যবান খবর।”
সদাশিব মৃদু একটু হেসে নবীনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “গোপন খবর মানে কি সেই দিঘির তলায় মন্দির? আরে পাগল! সেটা তো কিংবদন্তি।”
নবীন মাথা নেড়ে বলল, “কিংবদন্তির মধ্যে অনেক সময় সত্য লুকোনো থাকে। সিদ্ধিনাথ নিশ্চয়ই কিছু জানতে পেরেছিল। নইলে কেন ওকে কেউ মারবে, বলুন?”
সদাশিব গম্ভীর হয়ে বললেন, “সেটা ঠিক। তবে যেই মারুক, সে রেহাই পাবে না। আমি পুলিশে খবর দিয়েছি, তারা এল বলে।”
পুলিশের কথায় নবীন খুব নিশ্চিন্ত হল না। কেটেরহাটে থানা নেই। আছে দু’ মাইল দূরে। পুলিশ এত দূর থেকে খুব বেশি কিছু করতে পারবে বলে তার মনে হয় না। কিন্তু মুখে সে কিছুই বলল না।
কলকাতার ডাক্তার সিদ্ধিনাথকে পরীক্ষা করে বেরিয়ে এসে বললেন, “লোকটার বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু খুব শক্ত ধাতের লোক।”
সদাশিব জিজ্ঞেস করলেন, “বাঁচবে?”
“বাঁচবে বলেই মনে হয়। তবে ভাল হয়ে উঠতে সময় লাগবে। দিন তিনেক একদম কাউকে কাছে যেতে দেবেন না।”
নবীন নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি এসে নেয়ে-খেয়ে ঘুম দিল। সারা রাত ঘুমোয়নি।