তিনজনে আবার এগোতে লাগল। গাছপালায় সরসর শব্দ হচ্ছে। আশপাশ দিয়ে শেয়ালের দৌড়-পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভারী নির্জন আর ছমছম করছে চার ধার।
কালীবাড়িটা এক সময়ে বেশ বড়ই ছিল। সামনে মস্ত নাটমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মূল মন্দিরের কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। চার দিকে শুধু ইট আর সুরকির স্থূপ জমে আছে।
মন্দিরের পিছনে এক সময়ে পুরোহিত থাকতেন। দু’খানা পাকা ঘর, একটু বারান্দা, একটা পাতকুয়ো। এই বাড়িটা হয়তো মন্দিরের মত পুরনো নয়। পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছিল। সেই ঘর দুখানা এখনও কালজীর্ণ হয়েও কোনও রকমে খাড়া আছে।
ভুজঙ্গ বলল, “আলোটা জ্বলছিল ওই ঘরে।”
টর্চের আলোয় দেখা গেল, দরজা-জানালাহীন দু’খানা ঘর হাঁ-হাঁ করছে। সামনে হাঁটুসমান ঘাস-জঙ্গল।
“তোমরা আর এগিও না। এখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি।”
সুটকেসটা রেখে ভুজঙ্গ টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেল।
বিলু আর অনু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। তারা ভিতু নয় ঠিকই, কিন্তু এই অচেনা পরিবেশে তাদের কিছু অস্বস্তি হচ্ছিল।
হঠাৎ ভুজঙ্গর গলা শোনা গেল, “বিলু, অনু, শিগগির এসো।”
ভাই-বোনে দৌড়ে গেল। বাঁ দিকের ঘরটার মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ভুজঙ্গ। মেঝের ওপর একটা লোক পড়ে আছে। টর্চের আলোয় দেখা গেল, রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে।
বিলু আর অনু প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, “এ কে, ভুজঙ্গদা?” ভুজঙ্গ মুখটা তুলে বলল, “সিদ্ধিনাথ।”
“কে সিদ্ধিনাথকে মারল?”
“ও কি মরে গেছে?”
ভুজঙ্গ মাথা নেড়ে বলল, “মরেনি। নাড়ি চলছে। তবে মাথায় চোট লেগেছে। বেশিক্ষণ এইভাবে থাকলে রক্ত বেরিয়েই মরে যাবে। বয়সও তো কম নয়।”
অনু বলল, “তা হলে কী করবে এখন?”
“ফেলেও তো যেতে পারি না।”
বিলু বলে উঠল, “কাঁধে করে নিয়ে গেলে কেমন হয়?”
ভুজঙ্গ মাথা নেড়ে বলল, “কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গেলে ওর মাথাটা নীচের দিকে থাকবে। সেটা ওর পক্ষে ভাল হবে না। একমাত্র উপায় হচ্ছে একটা খাঁটিয়া-টাটিয়া জোগাড় করে চার-পাঁচজন মিলে বয়ে নিয়ে যাওয়া।”
অনু আর বিলু পরস্পরের দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, “আমরা তো তিনজন আছি।”
ভুজঙ্গ বলল, “তিনজনে হবে না। আমাদের নিজেদেরও মালপত্র আছে। তা ছাড়া, খাঁটিয়া পাব কোথায়? তার চেয়ে তোমরা দু’জন যদি গিয়ে লোকজন পাঠাতে পারো তবে হয়। আমি সিদ্ধিনাথকে পাহারা দিচ্ছি। যারা ওকে মেরেছে, তারা আশেপাশে কোথাও ওঁত পেতে থাকতে পারে। পুরোটা মারতে পারেনি, বোধহয় আমাদের সাড়া পেয়ে পালিয়েছে। তবে ফিরে আসতে পারে।”
বিলু চোখ গোল করে বলল, “তুমি একা থাকবে?”
“উপায় কী? সিদ্ধিনাথ অনেক দিনের বন্ধু আমার। ওকে। ফেলে তো যেতে পারি না। এখন কথা হল, বাকি রাস্তাটা তোমরা যেতে পারবে কি না।”
অনু মাথা নেড়ে বলল, “খুব পারব।”
“যদি তোমাদের কিছু হয়, তবে কতাবাবু আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবেন।”
অনু বলল, “কিছু হবে না ভুজঙ্গদা। আমি অত ভিতু নই।”
“তা হলে দেরি করো না। রুমাল দিয়ে সিদ্ধিনাথের মাথাটা বেঁধেছি বটে, কিন্তু ভালমতো ব্যাণ্ডেজ করতে হবে। কে জানে, হয়তো স্টিচও লাগবে। পারলে ফটিক ডাক্তারকেও পাঠিয়ে দিও। সুটকেসটা থাক, পরে লোকজন এলে নিয়ে যাওয়া যাবে।”
বিলু একটু মিনমিন করে বলল, “দিদি আর আমি! না বাবা, আমি বরং থাকি। দিদি একা যাক।
ভুজঙ্গ একটু হেসে বলল, “তুমি না পুরুষমানুষ! অত ভয় কিসের? রাস্তা আর বেশি তো নয়। একটু গেলেই ঝিলের ধারে পড়বে। ওখান থেকে কেটেরহাট দেখা যায়।” অনিচ্ছার সঙ্গে বিলুকে রাজি হতে হল।
৫. সন্ধে হয়ে অন্ধকার নেমেছে
কখন সন্ধে হয়ে অন্ধকার নেমেছে, তা নবীনের খেয়াল ছিল। ভাঙা ফোয়ারার ধারে বসে পূর্বপুরুষদের কথা ভাবতে ভাবতে সে একেবারে বিভোর হয়ে গিয়েছিল।
পূর্বপুরুষদের সঙ্গে তার কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি বটে, কিন্তু তাঁদের গল্প সে মেলাই শুনেছে। তাঁরা ডাকাতি করে বেড়াতেন বটে, কিন্তু গরিব-দুঃখীদের উপকারও করতেন খুব। যে গাঁয়ে জল নেই, সেখানে পুকুর কাটিয়ে দিতেন; যার ঘর পড়ে গেছে, তার ঘর তুলে দিতেন; বিপন্নকে রক্ষা করতেন; জমিদারের পাইকরা হামলা করলে উলটে তাদের শিক্ষা দিয়ে দিতেন। তাঁরা প্রায়ই বিশাল ভোজ দিয়ে পাঁচ-সাতটা গাঁয়ের লোককে ডেকে আকণ্ঠ খাওয়াতেন। তাঁদের যত দোষই থাক, গুণেরও অভাব ছিল না। তার এক পূর্বপুরুষ এক-ডুবে নদী পারাপার করতে পারতেন। আর একজন এমন লাঠি ঘোরাতেন যে, বন্দুকের গুলি অবধি গায়ে লাগত না। আর-একজন কুস্তিতে ভারত-বিখ্যাত ছিলেন।
ভাবতে-ভাবতে নবীন এমন বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে, মশার কামড় অবধি টের পাচ্ছিল না।
হঠাৎ বাতাসে একটা গুনগুন ধ্বনির মতো কী একটা শোনা গেল। নবীন চোখ বুজে ছিল।
কে যেন বলল, “তাকাও! তাকাও! ওপরে-নীচে, ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে।”
নবীন চমকে উঠল।
“কে?”
না, কেউ নেই।
মহাদেব এসে ডাকল, “কী গো দাদাবাবু, আজ কি বাগানেই রাতটা কাটাবে নাকি? ঠাণ্ডা পড়েছে না? এই শীতে এখানে বসে কোন্ খোয়াব দেখছ শুনি? পিসিঠাকরুণ যে ডেকে-ডেকে হয়রান!”
নবীন তাড়াতাড়ি মহাদেবের হাত চেপে ধরে বলল, মহাদেবদা, আমি এইমাত্র কার যেন কথা শুনলাম।”
“তোমার মাথাটাই গেছে। ওঠো তো, ঘরে চলো।”
নবীন উঠল। তার মনে হচ্ছিল, সে ভুল শোনেনি। পাতালঘরেও আজ সে কার যেন গলা শুনতে পেয়েছে। কে যেন বলছিল, “ওভাবে নয়।”