“তা হলে কী হবে?”
ভুজঙ্গ বলল, “গাড়ি রং এখানে থাক। পরে বচন তার লোজন নিয়ে এসে ঠেলে নিয়ে যাবে। আমি সুটকেসটা নিই, তোমরা দুজন ব্যাগগুলো কাঁধে ঝুলিয়ে নাও। তার পর চলল, হেঁটে চলে যাই।”
একথায় বিলু লাফিয়ে উঠে বলল, “সেইটেই ভাল হবে। চলো, ডাকাতে কালীবাড়ির রাস্তা দিয়ে শর্টকাট করি। ওখানে এক সময়ে ঠ্যাঙাড়েরা মানুষ মারত।”
ভুজঙ্গ চিন্তিতভাবে বলল, “ও রাস্তায় মাইলটাক পথ কমে যাবে ঠিকই, কিন্তু…”
অনন্যা নেমে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দু’জনের কথা শুনছিল। একটু হেসে বলল, “কিসের ভয় ভুজঙ্গদা? আমি ক্যারাটে-কুংফু জানি। তুমিও এক সময়ে সাকাসে খেলা দেখাতে। ভয়টা কিসের? একমাত্র বিলুটাকে নিয়েই যা চিন্তা। ও তো কিছু জানে না!”
বিলু বিদির বেণীটা একটু নেড়ে দিয়ে বলল, “বেশি ফটফট করিস না। স্কুলে প্রত্যেকবার হান্ড্রেড মিটারে কে ফাস্ট হয়?”
অনন্যা বলল, “দৌড় তো একটা কাজেই লাগে। পালানোর সময়। যাই হোক, বিপদে পড়লে তুই অন্তত পালাতে পারবি।”
ভুজঙ্গ লাগেজ বুট থেকে সুটকেস নামিয়ে আনল। বড়দিনের বনধে সপ্তাহখানেক ছুটি কাটাতে ভাইবোন দাদুর কাছে যাচ্ছে। কাজেই মালপত্র এবার একটু বেশি। বিলু আর অনু চটপট তাদের হ্যান্ডব্যাগ নামিয়ে নিল।
গাড়ি লক করে তিনজনে হাঁটা ধরল। সঙ্গে টর্চ আছে, অন্ধকার হয়ে গেলে চিন্তা নেই।
সিকি মাইল এগোলে ডান ধারে ডাকাতে কালীবাড়ির রাস্তা। দিনমানেও লোক-চলাচল বিশেষ নেই। জঙ্গলে কিছু লোক কাঠকুটো কুড়োতে যায়। গ্রাম বা লোকবসতি না থাকায় পথটা ভারী নির্জন।
ঝোঁপ-ঝাড়ের ভিতর দিয়ে সরু রাস্তা। এই রাস্তা গিয়ে ঝিলের পাশ দিয়ে কেটেরহাটে ঢুকেছে। শোনা যায়, এই রাস্তাই ছিল এক সময়ে কেটেরহাটের সঙ্গে বহির্জগতের একমাত্র সংযোগ-পথ। কিন্তু ঠ্যাঙাড়ে আর ডাকাতদের অত্যাচারে সন্ধের পর এ রাস্তায় কেউ পা দিত না। এখন আর ঠ্যাঙাড়ে বা ডাকাতদের ভয় নেই, কিন্তু তবু লোকে পথটা এড়িয়েই চলে।
ডাকাতে কালীবাড়ির রাস্তায় যখন তারা পা দিল, তখন অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে উঠেছে। মালপত্র নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হাঁটা সম্ভব নয়। তবু তারা যথাসাধ্য দ্রুত হাঁটছিল।
বিলু ডাকল, “ভুজঙ্গদা!”
“বলো দাদাবাবু।”
“কালীবাড়িটা কত দূর?”
“মাঝামাঝি পড়বে।”
“এখনও কি সেখানে পুজো হয়?”
“পাগল! কালীবাড়ি এখন শেয়ালের আস্তানা।”
“আচ্ছা, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তো ডাকাত ছিল!”
“তা ছিল। কেটেরহাটের বারো আনা লোকই ডাকাত ছিল।”
“তারা কি কুংফু ক্যারাটে জানত?”
“জানত বই কী, ভালই জানত।”
“দিদিও জানে?”
“হ্যাঁ।”
“দিদি, তুই তা হলে দেবী চৌধুরানির মতো ডাকাত হয়ে যা।”
“বয়ে গেছে। ডাকাত তো তুই হবি। যা বাঁদর হয়েছিস!”
“আমি হব টিনটিন। ভুজঙ্গদা হবে আমার ক্যাপ্টেন হ্যাঁডক, আর দাদুকে বানাব প্রোফেসর ক্যালকুলাস।”
ভুজঙ্গ মাঝে-মাঝে সুটকেসটা নামিয়ে রেখে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। বলল, “ডাকাতে কালীবাড়ি আর দূরে নয়। ওটা পেরোলেই ঝিলের ধারে গিয়ে পড়ব। ওখান থেকে কেটেরহাটের আলো দেখা যায়।”
ঝিঝির শব্দ হচ্ছে। মাঝে-মাঝে শেয়াল ডেকে উঠছে ঝাঁক বেঁধে। গাছে পাখিদের ঝটাপটি। জোনাকি জ্বলছে থোকা-থোকা।
“ভুজঙ্গদা, তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?”
“খুব করি দাদাবাবু।”
“কখনও দেখেছ?”
“না। তবে জানি।”
“আমি করি না।”
অনু ফোড়ন কাটল, “আর সাহস দেখাতে হবে না। এখনও একা ঘরে শুতে পারিস না।”
তিনজনে ফের রওনা হতে যাবে, ঠিক এই সময়ে জঙ্গল ভেঙে কাছাকাছি কী একটা যেন দৌড়ে গেল।
ভুজঙ্গ বলল, “শেয়াল। চলো।”
তিনজনে নিঃশব্দে এগোতে লাগল। আঁকাবাঁকা পথ। দু’ ধারের গাছপালা ঝুঁকে এসে পড়েছে পথের ওপর। গায়ে লেগে
খরখর শব্দ হচ্ছে।
হঠাৎ কাছেই একদল শেয়াল চেঁচাল।
ভুজঙ্গ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “ওই যে! ওই হল কালীবাড়ি। কিন্তু…এ কী?”
বিলু বলল, “কী হল ভুজঙ্গদা?”
“কালীবাড়িতে আলো কিসের?”
এ-জায়গায় চারদিকেই নিবিড় বাঁশবন। বাঁশবনের ভিতরে বাঁ ধারে প্রায় তিনশো গজ দূরে প্রাচীন কালীবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। গাছ-টাছ গজিয়ে জায়গাটার এমন অবস্থা হয়েছে যে, দিনের বেলাতেও ধ্বংসস্তৃপটাকে ভাল করে ঠাহর হয় না। ঘুটঘুটি অন্ধকারে সেই ধ্বংসস্তৃপ থেকে একটা মৃদু আলোর রেশ আসছিল। ভাল করে ঠাহর করলে দেখা যায়, নইলে নয়।
বিলু বলল, “অবাক হচ্ছ কেন? কেউ হয়তো আছে ওখানে।”
ভুজঙ্গ সন্দিহান গলায় বলল, “কেটেরহাটে আমার জন্ম, বুঝলে? আমি এ-জায়গার নাড়ি-নক্ষত্র জানি। এ-তল্লাটের লোক কেউ এখানে সন্ধের পর আসবার সাহস রাখে না। তোমরা এখানে দাঁড়াও, ব্যাপারটা আমাকে একটু দেখতে হচ্ছে।”
অনু বলে উঠল, “তুমি একা যাবে কেন? চলো, আমরাও সঙ্গে যাচ্ছি।”
“তোমরা যাবে! কী দরকার। আমি যাব আর আসব।”
“আমরা অত ভিতু নই ভুজঙ্গদা। চলো, দেখি কোন ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো ওখানে আস্তানা গেড়েছে।”
ভুজঙ্গ টর্চ হাতে আগে-আগে চলল, এক হাতে সুটকেস। পিছনে অনু আর বিলু।
“এই যাঃ!”
“কী হল ভুজঙ্গদা?”
“আলোটা যে নিবে গেল!” তিনজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাস্তবিকই কালীবাড়ির আলোটা আর নেই।
বিলু বলল, “তা হলো চলো, ফিরে যাই। আমার খিদে পেয়েছে।”
ভুজঙ্গ বলল, “আলো নিবে গেল তো কী! কেউ হয়তো এখনও ওখানে আছে। একবার দেখে যাওয়া ভাল।”