- বইয়ের নামঃ ঝিলের ধারে বাড়ি
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. সদাশিববাবু সকাল বেলায়
ঝিলের ধারে বাড়ি – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সদাশিববাবু সকাল বেলায় তাঁর পুব দিকের বারান্দায় শীতের রোদে বসে পাঁচ রকম তেতো পাতার এক কাপ রস আস্তে-আস্তে তারিয়ে-তারিয়ে খাচ্ছিলেন। এ-হল পঞ্চতিক্ত। ভারী উপকারী। সামনে বেতের টেবিলে গত কালকের তিনখানা খবরের কাগজ, একখানা পঞ্জিকা, ডায়েরি আর কলম। আজ বন্দুক পরিষ্কার করার দিন। তাই বচন পাশে আর-একটা কাঠের টেবিলে তিনখানা ভারী বন্দুক, বন্দুকের তেল, শিক, ন্যাকড়া সব সাজিয়ে রেখে গেছে। রসটা শেষ করেই সদাশিববাবু খবরের কাগজে চোখ বোলাবেন। তার পর পঞ্জিকা খুলে আজকের তিথিনক্ষত্র ভাল করে ঝালিয়ে নেবেন। ডায়েরিতে কাল রাতে যা লিখেছেন, তার ওপর একটু সংশোধন করবেন। তার পর বন্দুক পরিষ্কার করতে বসবেন। এক-এক দিন এক-এক রকম কাজ থাকে। কোনও দিন বন্দুক পরিষ্কার করা, কোনও দিন এগারোটা দেওয়ালঘড়িতে দম দেওয়া, কোনও দিন পুরনো জিনিসপত্র রোদে বের করে ঝাড়পোঁছ করা, কোনও দিন চিঠি লেখা ইত্যাদি।
চার দিকে প্রায় কুড়ি বিঘে জমি আর বাগান দিয়ে ঘেরা সদাশিববাবুর বাড়িটা খুবই বিশাল। এ-বাড়িতে যে কতগুলো ঘর আছে, তার হিসেব সদাশিববাবুরও ভাল জানা নেই। শোনা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষেরা ডাকাত ছিলেন। ডাকাতি করে ধনসঞ্চয়ের পর জমিদারি কিনে ব্রিটিশ আমলে ‘রাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন। এ বাড়িতে আগে কালীপুজোয় নরবলি দেওয়া হত। সদাশিববাবুর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ-কেউ তান্ত্রিক ছিলেন, এবং একজন শবসাধনায় সিদ্ধিলাভ করে অনেক অলৌকিক কাণ্ডকারখানাও করতেন। কুলপঞ্জিকায় এ সব ঘটনার কিছু-কিছু হদিস সদাশিববাবু পেয়েছেন। তবে এখন সবই ইতিহাস।
সদাশিববাবুর একটি মাত্র ছেলে। সেই ছেলে কলকাতায় বেশ বড় চাকরি করে। নাম রামশিব। রামশিবের এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ে অনন্যার বয়স বছর পনেরো, ছেলে বিহুশিবের বছর-দশেক বয়স। দুজনেই কলকাতার নামজাদা ইংরেজি স্কুলে পড়ে। তারা দাদুর বেজায় ভক্ত এবং বেজায় বন্ধুও। সপ্তাহে শনিরবিবার এসে দাদুর কাছে থেকে যায়। অনেক সময়ে রামশিব নিজেই মোটর চালিয়ে নিয়ে আসে, নয়তো ড্রাইভার ভুজঙ্গই আনে। সারা সপ্তাহ সদাশিব নাতি আর নাতনির জন্য অপেক্ষা করেন।
সদাশিবের স্ত্রী এখনও বেশ শক্তপোক্ত আছেন সদাশিবের মতোই। সারা দিনই নানা রকম কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এই রাঁধছেন, এই ডালের বড়ি দিচ্ছেন, এই নাড় পাকাচ্ছেন, এই আচার বানাচ্ছেন। সপ্তাহান্তে নাতি-নাতনি এসে খাবে বলে হরেক রকম খাবার বানিয়ে রাখেন। সদাশিব তাঁর টিকিও নাগাল পান না সারা দিন।
তবে সদাশিবের আছে বচন মণ্ডল। সব কাজের কাজী।
সেই বচন মণ্ডলই হঠাৎ এসে উদয় হল। এবার খুব সাঙ্ঘাতিক রকমের শীত পড়েছে বলে সদাশিববাবুর পুরনো কাশ্মিরি একখানা ফুলহাতা সোয়েটার বচনকে দেওয়া হয়েছে। বচন সাইজে সদাশিবের অর্ধেক। সেই ঢলঢলে সোয়েটার হাতাটাতা গুটিয়ে পরে, মাথায় একখানা মিলিটারি টুপি চাপিয়ে যা একখানা সং সেজেছে, তাতে দিনে-দুপুরে দেখলেও লোকে আঁতকে ওঠে। বচন মণ্ডল বয়সে ছোঁকরা, তবে হাবভাব বিচক্ষণ বৃদ্ধদের মতোই। মুখে বড়-একটা হাসি নেই। বরং দুশ্চিন্তার ছাপ আছে।
বচন উদয় হয়ে বলল, “আজ্ঞে, তিনজন বাবু দেখা করতে এয়েছেন।”
শীতের সকালে এই সবে সওয়া ছ’টা, এর মধ্যে কারা এল? সদাশিব জিজ্ঞেস করলেন, “কারা রে?”
“এখানকার লোক নয়। বাইরের। মোটরগাড়ি নে এয়েছেন। পেল্লায় মোটর। ঢুকতে দিইনি বলে আগ করেছেন খুব।”
“ঢুকতে দিসনি কেন?”
সঙ্গে যে পেল্লায় এক রাগী কুকুর। বাগানে খরগোশ ছাড়া আছে, বেড়ালছানারা বাইরে রোদ পোয়াচ্ছে, রহিম শেখের মুরগিরা দানা খাচ্ছে, হরিণ চরছে, আমাদের তিনঠেঙে ভুলুও আছে। কাকে কামড়ায় কে জানে!”
সদাশিববাবু কুঁচকে বললেন, “অ। তা বাবুরা সাত-সকালে কুকুর নিয়ে এলেন কেন? তা যাক গে, কী চায় জিজ্ঞেস করেছিস?”
“করেছি। তবে তাঁরা জবাব দিতে চাইছেন না। কটমট করে তাকাচ্ছেন।”
“বটে! মতলবখানা কী?”
“খারাপও হতে পারে, ভালও হতে পারে।”
“তা বাবুদের বল্ গে, কুকুর গাড়িতে রেখে এবং গাড়ি বাইরে রেখে পায়ে হেঁটে আসতে।”
“তাই বলি গে।” বচন চলে গেল। সদাশিববাবু ভ্রূ কুঁচকেই রইলেন। এই জায়গা হল কেটেরহাট, যাকে বলে ধাঁধাড়া গোবিন্দপুর। কাছেই বাংলাদেশের সীমানা। এ রকম জায়গায় বাবুভায়েরা বড় একটা আসেন না। এঁরা কারা এলেন তবে?
পঞ্চতিক্তের গেলাসখানা খালি করে রেখে দিলেন সদাশিববাবু। তার পর খবরের কাগজ তুলে নিলেন। এখান থেকে ফটক অবধি অনেকখানি পথ। বাবুভায়েদের হেঁটে আসতে সময় লাগবে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ তিনঠেঙে ভুলুর চ্যাঁচানিতে সদাশিববাবু বুঝলেন, বাবুভায়েরা আসছেন। ভুলুর মাত্র তিনটে ঠ্যাং হলে কী হয়, গলায় দশটা কুকুরের জোর। তিন ঠ্যাঙে নেচে নেচে সে যে-কোনও আগন্তুককেই বকাঝকা করতে ছাড়ে না।
সদাশিববাবু খবরের কাগজখানা নামিয়ে রাখলেন। সামনে অনেকটা ঘাসজমি, তার পর সবজির বিস্তৃত বাগান, তার ধারে-ধারে নারকোল, পাম আর ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। মোরামের পথ ধরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে জনা-তিনেক কোটপ্যান্ট-পরা লোককে আসতে দেখা গেল, তাদের আগে-আগে বচন আর ভুলু।