জিনিসগুলো গামছায় বেঁধে নিয়ে উঠতে যেতেই পেছন থেকে কে যেন চাপা গলায় বলল, “ভজহরি তো তোমার কাছে নস্যি হে। যা হাতের কাজ দেখালে! আহা! চোখ জুড়িয়ে যায়।”
দুর্গা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কেউ দেখে ফেলেছে নাকি? তা হলে তো আবার সাক্ষীও জুটল।
কাছেপিঠে থেকে আরও একজন চাপা গলায় বলল, “অর্ধেক কাজ করে যাও কোথা হে! হাতঘড়িটা রইল যে! আসল সোনার ঘড়ি, মেলা দাম।”
দুর্গার অস্বস্তি বাড়ল। পেছনের লোকগুলো কি ভজহরির খেলা ছেড়ে এতক্ষণ তার খেলা দেখছিল নাকি রে বাবা? তা হলে তো ভারী লজ্জার কথা! দুর্গা ভিড়ের ভেতর দিয়েই পথ করে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। কাজটা হয়ে গেছে বটে, কিন্তু বড্ড কিন্তু কিন্তু লাগছে দুর্গার। আজ অবধি সে এত পরিষ্কার হাতে কখনও কোনও কাজ করে উঠতে পারেনি। কিন্তু কাজটা করে উঠে তেমন স্বস্তি বোধ করছে না তো!
বেরিয়ে এসে দুর্গা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, হঠাৎ কোথা থেকে একজন টেকো মাঝবয়সি লোক সেঁতো হাসি হাসতে হাসতে এসে পট করে তার গলায় একটা গাঁদার মালা পরিয়ে দিয়ে বলল, “অভিনন্দন! অভিনন্দন!”
দুর্গা আঁতকে উঠে বলে, “এসব কী ব্যাপার?”
লোকটা ভারী অমায়িক গলায় বলে, “এ হল গুণী মানুষের সম্মান। এত বড় একজন ওস্তাদ লোককে সম্মান জানানো তো দেশ আর দশের কর্তব্যই হে! তাই না?”
দুর্গা মালো প্রমাদ গুনল। তার মন কু ডাক ডাকতে লেগেছে। এসব যা হচ্ছে তা তো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এর মধ্যে যে গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে তার!
হঠাৎ দুর্গা পড়ি-কি-মরি করে ছুটতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাকে তাড়াও করল না, ধর, ধর বলে শোরগোলও তুলল না। তাতে ভয়টা আরও বেড়ে গেল দুর্গার। সে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল।
৪. ঝিকরগাছার হাটে ঘুরে বেড়ানো
নাঃ, ঝিকরগাছার হাটে আজ ঘুরে বেড়ানোই সার হল। কিছুই ঘটল না তেমন। জম্পেশ কিছু একটা না ঘটলে এই হাটেবাজারে আসার সুখটাই থাকে না কিনা। ঘুরে ঘুরে নবকান্ত ভারী হেদিয়ে পড়ছিল।
সেই চোত মাসের দ্বিতীয় হপ্তায় একবার আগুন লেগেছিল হাটে। আহা, কী দৃশ্য! চোখ জুড়িয়ে যায়। আগুন বাবাজীবন কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে দরমা আর তেরপলের দোকানগুলো গপাগপ সাবাড় করছিল। লহমায় উত্তর দিকটা সাফ হয়ে গেল একেবারে। আর আগুনেরও বাহার কী! যেমন রাঙা রংখানা, তেমনই তেজ! তেমনটি আর দেখল না নবকান্ত আজ অবধি। আগুনের হলকা না হোক খাট-সত্তর ফুট উঁচুতে উঠেছিল।
বোশেখটাও খারাপ যায়নি। সংক্রান্তির আগের দিনই হবে। ঝিকরগাছার জমজমাট হাটের মধ্যে শিবের ষাঁড় কেলো-হাবুকে কে যেন খেপিয়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর ওঃ! সে কী লন্ডভন্ড কাণ্ডটাই না হল! প্রথমেই উড়ে গেল পটলওলা গদাই দাস। চারদিকে পটলগুলো যেন বন্যার মতো ঢেউ খেলে ছড়িয়ে পড়ছিল। ক্ষ্যামা নন্দীর আলুর পাইকারি কারবার। বিরাট দাঁড়িপাল্লায় পেল্লায় পেল্লায় বস্তা ওজন হচ্ছিল। কেলোহাবুর গুতোয় বস্তাসুদু আলু শূন্যে উঠে চারদিকে শিলাবৃষ্টির মতো আলু ঝরে পড়তে লাগল। কানা বোষ্টম হরেন গোঁসাই নিতাই খ্যাপার গান গেয়ে তোক জমাচ্ছিল। তা বোষ্টমের পো কেলো-হাবুর গুঁতায় উড়ে গিয়ে পড়ল নিধিরামের দোকানের চালে। ছুটে পালাতে গিয়ে জ্ঞান মাস্টারের ধুতি খুলে নিশানের মতো উড়তে লাগল। নবকৃষ্ণের জিলিপির কড়াই উলটে সারা গায়ে ফোঁসকা। কত লোকের যে উলটোপালটা পালাতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে হাত পা ভেঙেছিল, তার লেখাজোখা নেই। আহা, দেখেও সুখ।
তারপর মাস দুই বড্ড মন্দা গেছে বটে। কিন্তু শ্রাবণ মাসেই ফের ঝিকরগাছার মেলায় লেগে গেল ধুন্ধুমার। ষষ্ঠীপুরের ছেলেদের সঙ্গে কালীগঞ্জের ছেলেদের সে কী মারপিট! কী না, ষষ্ঠীপুরের পন্টু নাকি কালীগঞ্জের জগুকে ‘রাঙামুলো’ বলেছিল। তাই থেকেই ঝগড়া। ঝগড়া থেকে মারপিট। তারপর মারপিট থেকে প্রায় দাঙ্গা। বিনা কারণেই হাটের লোকেরা কেউ ষষ্ঠীপুরের পক্ষ নিয়ে, কেউ বা কালীগঞ্জের পক্ষ নিয়ে যাকে-তাকে ধরে পেটাতে লাগল। তারপর কে যে কাকে পেটাচ্ছে আর কেন পেটাচ্ছে তা নিজেরাও বুঝতে পারছিল না। ওঃ সে যা কাণ্ড হয়েছিল একখানা কহতব্য নয়! তবে হ্যাঁ, যাত্রা, থিয়েটার, কবির লড়াই কিছুই এর কাছে লাগে না। দু’ চোখ ভরে শুধু দেখে যাও।
পুজোর মাসটা বাদ দিয়ে কার্তিকের পয়লা হপ্তাতেই কাণ্ডটা কিছু খারাপ হল না। সাতটা থানার হৃৎকম্প তুলে বিখ্যাত ডাকাত নেলো চারদিকে যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল তাতে গেরস্তর রাতের ঘুম বলে কিছু ছিল না। দারোগা-পুলিশ তার কিছু করতে পারত না। কত মোটাসোটা দারোগা শুকিয়ে কাঠি হয়ে গিয়েছিল দুশ্চিন্তায়। তা সেই নেলো কার্তিক মাসের পয়লা হাটবারে কেন যে মরতে ঝিকরগাছার হাটে এসেছিল কে জানে!মতিভ্রমই হবে। শোনা যায়, সে নাকি মেয়ের জন্য ডায়মন্ডকাটা পুঁতির মালার সন্ধানে ঝিকরগাছায় হাজির হয়।
ওদিকে পুলিশের আড়কাঠিরা খবর পৌঁছে দিয়েছে থানায়। সাতটা থানার পুলিশ আর দারোগা এসে হাট ঘিরে ফেলেছিল। কিন্তু মুশকিল হল তারা কেউ নেলোকে চাক্ষুষ চেনে না। লম্বাচওড়া লোক দেখলেই নেলো মনে করে টপাটপ বেঁধে ফেলছে। প্রথমেই ধরা পড়ে গেলেন মহেশতলা হাই স্কুলের ড্রিল-সার। যতই চেঁচামেচি করেন ততই পুলিশ তাঁকে আরও শক্ত করে বাঁধে। গজেনবাবু সাতে-পাঁচে নেই, উবু হয়ে বসে বেগুন কিনছিলেন। পুলিশ তাঁকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গোরুর গাড়িতে তুলে চালান দিল। ব্যায়ামবীর নন্দদুলাল কর্মকার পেশি প্রদর্শনীতে নাম দেবে বলে এসে পুলিশের হাতে কী নাকালটাই হল! ব্যায়ামবীর হলে কী হয়, নন্দদুলাল ভারী ভিতু মানুষ। পুলিশে ধরতেই কেঁদেকেটে একশা। তাইতে পুলিশের সন্দেহ আরও ঘোরালো হল তার ওপর। রুল দিয়ে কী গুঁতোই দিচ্ছিল সবাই মিলে। আহা, দেখেও সুখ! শেষ অবধি প্রায় দেড়শো নকল নেলোকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। পরে জানা গেল আসল নেলো নাকি মোটে পাঁচ ফুটের বেশি লম্বাই নয়। আর ভারী রোগাভোগা নিরীহ চেহারার মানুষ।