ঠিক সেই সময়ে মাধব পণ্ডিত “বাবা রে, গেছি রে” বলে এমন চেঁচামেচি জুড়ল যে, বলার নয়! হাতসই না হওয়ায় একটু খোঁচা লেগেছিল বটে, একটু রক্তপাতও হয়েছিল। কিন্তু তা বলে চেঁচামেচি করার কোনও মানে হয়? ভক্তিভাব এলে মানুষ যখন উঁচুতে উঠে যায় তখন কি তুচ্ছ বিষয়আশয় বা শরীরের ব্যথা বেদনার কথা খেয়াল থাকে? নাকি থাকাটা উচিত? ছ্যাঃ ছ্যাঃ, কলিকালে ভক্তিভাবটাবগুলোও রামলাখন গয়লার দুধের মতো জলমেশানো জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমন ভক্তিভাব হলে গলাখানা কেটে ফেললেও টের পাওয়ার কথা নয়। অমন সুযোগটা মাঠে মারা গেল।
তাই তখন বাধ্য হয়েই রাতের দিকে যখন কীর্তনের পর মাধব পণ্ডিত একা বাড়ি ফিরছিল তখন দুর্গা মুখোনা গামছায় ঢেকে তার ওপর চড়াও হল। মাথায় ডান্ডা মেরে ফেলে দিয়ে ঘড়ি আর গোট কেড়ে নিতে হল। মোটা দাগের কাঁচা কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্গাই বা করে কী?
কিন্তু যুধিষ্ঠির ঘটনা শুনে আঁতকে উঠে বলল, “করেছিস কী সব্বোনেশে কাণ্ড? মাধব পণ্ডিতের ছোট জামাই যে মণিরামপুরের দারোগা! যা যা, দূর হয়ে যা, ও ঘড়ি আমি আর ছোঁবও না। তল্লাট জুড়ে এখন পুলিশের হামলা হবে।”
সেই শুনে দুর্গারও পিলে চমকাল। পরদিন গভীর রাতে গিয়ে মাধব পণ্ডিতের ঘরের জানালা দিয়ে ঘড়ি আর গোট রেখে এল।
তার হাতে সূক্ষ্ম কাজ হয় না বটে, কিন্তু তা বলে চেষ্টার সে কোনও ত্রুটি করে না। প্রথমটায় হাতসাফাইয়ের চেষ্টাই সে করে। তাতে কার্যোদ্ধার না হলে মোটা দাগের পন্থা নেয়।
আজকের কাজটিও সূক্ষ্মভাবেই হাসিল করার চেষ্টা করছে দুর্গা। রাজা গজার মতো চেহারার যে লোকটার পিছু নিয়ে সে ঘুরছে তার সর্বাঙ্গে যেন টাকার বিজ্ঞাপন। পকেটে পাঁচ-দশ হাজার নগদ, গলায় মোটা সোনার চেন, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, আঙুলে গোটাসাতেক হিরে, মুক্তো, চুনি, পান্নার আংটি। একুনে প্রায় লাখ টাকার মাল তো হবেই।
লোকটার পিছু পিছুই ভজহরির ম্যাজিক শোতে ঢুকে পড়েছে দুর্গা। তারপর সামনের সারিতে বসা লোটার ঠিক পেছনেই ঘাপটি মেরে বসেছে।
স্টেজের ওপর ভজহরি তার এলেবেলে মামুলি খেলাগুলো দেখিয়ে যাচ্ছে। খুব মন দিয়ে দেখছে লোকটা। বাহ্যজ্ঞান নেই। স্টেজের ওপর ভজহরি তার এক শাগরেদকে লম্বামতো একটা বাক্সে পুরে বাক্সটা করাত দিয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে কাটছে।
খুব মোলায়েম হাতে লোকটার পাঞ্জাবির বাঁ পকেট থেকে টাকার গোছাটা বের করে নিল। লোকটা টেরও পেল না। দুর্গা এরপর একটু অপেক্ষা করল। ভজহরি বাক্সটা কেটে ফেলেছে। এমনভাবে কেটেছে যে, বাক্সের সঙ্গে তার শাগরেদেরও কেটে দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাই কি হয়? ভজহরি বাক্সটা একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকেই ঢাকনাটা সরিয়ে নিল। শাগরেদ লাফিয়ে উঠে সবাইকে সেলাম জানাতে লাগল। আর তুমুল হাততালি উঠল চারদিকে। আর সেই হাততালির মধ্যেই দুর্গা খুব নরম হাতে কাটারটা ধরে লোকটার গলার চেনটা কট করে কেটে ফেলে টেনে নিল। এ কাজটা অবশ্য খুব সূক্ষ্ম হল না। দুর্গার মনে হল হারটা কাটবার সময় কাটারটার একটা খোঁচা লেগেছে লোকটার গলায়। কিন্তু খেলা দেখে লোকটা এতই মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছিল যে, খোঁচাটা খেয়ালই করল না। এরকম ক্ষণজন্মা পুরুষ না হলে কি কাজ করে সুখ!
ভজহরি এরপর একটা খালি টুপির ভেতর থেকে প্রথমে তিনটে পায়রা আর তারপর তিন তিনটে খরগোশ বের করল। লোকটা খুব মন দিয়ে খেলা দেখছে। দেখতে দেখতে আনমনে হাতের আংটিগুলো একটা একটা করে খুলছে আর পরছে, খুলছে আর পরছে। অনেকের এরকম চঞ্চল স্বভাব আছে বটে। দুর্গা খুব ঠাহর করে ব্যাপারটা লক্ষ করতে লাগল। শেষ অবধি লোকটা আংটিগুলো খুলেই ফেলল। তারপর অবহেলাভরে পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে রেখে দিল।
আহা, দেশটায় যে কেন এরকম লোক আরও অনেক জন্মায় না কে জানে! দুর্গা ফের ওস্তাদজিকে স্মরণ করে খুব মোলায়েম হাতে আংটিগুলো বের করে নিল। এত চমৎকার ভাবে কাজ হাসিল হয়ে যাচ্ছে দেখে দুর্গা নিজেও অবাক।
আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে ভেবে দুর্গা উঠে পড়তে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময়ে ভজহরি তার পরের খেলা শুরু করেছে। তার এক শাগরেদকে একটা কাঠের তক্তার গায়ে দাঁড় করিয়ে ভজহরি চোখ বেঁধে একের পর এক ছোরা ছুঁড়ে মারতে লাগল আর সেগুলো সাঁত সাঁত করে গিয়ে শাগরেদের শরীর ঘেঁষে তক্তায় গেঁথে যেতে লাগল।
এই খেলা দেখে লোকটা এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, “উঃ বড় গরম লাগছে তো,” বলে গা থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে পাশের খালি জায়গাটায় রেখে দিল।
ভগবান যখন দেন তখন এভাবেই দেন। দিয়ে যেন আশ মেটে। দিতে দিতে যেন ভগবানের একেবারে খুন চেপে যায়। নিতে না চাইলেও জোর করে যেন গছাবেনই। ভগবানকে চটাতে যাবে কোন আহাম্মক? দুর্গা তাই পাঞ্জাবি থেকে চটপট বোতাম খুলে নিল।
এত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে বহুকাল সে কোনও কাজ হাসিল করতে পারেনি। গৌরবে বুকখানা ভরে উঠল তার। দুঃখ এই, তার বন্ধুরা কেউ দেখতে পেল না, পেলে বুঝত দুর্গা সূক্ষ্ম হাতের কাজেও বড় কম যায় না!
কে যেন চাপা গলায় পেছন থেকে বলে উঠল, “সাবধান!” দুর্গা পট করে পেছনে তাকাল। গায়ে গায়ে অনেক লোক বসে ম্যাজিক দেখছে তন্ময় হয়ে। অন্ধকার বলে কারও মুখ ঠাহর হয় না! ম্যাজিক দেখেই বোধ হয় কেউ বাহবা দিল। যাক, তার কাজ হয়ে গেছে। এবার কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।