ভারী লজ্জায় লজ্জায় খাচ্ছিল সনাতন। তবে রামগোপালের রাবড়ি আর ছানাবড়া এতই ভাল জিনিস যে, লজ্জা সংকোচ বজায় রাখা কঠিন।
সনাতন খাচ্ছে আর নটবর সামনে বসে ‘আহা, উঁহু’ করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বলছে, “আহা, বেশ রসিয়ে রসিয়ে খান তো মশাই, অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বেশ গুছিয়ে ধীরেসুস্থে জিবে টাগরায় মাখিয়ে নিয়ে খেতে থাকুন।”
সনাতন বলল, “সেই চেষ্টাই তো করছি মশাই, কিন্তু রাবড়িটা যে জিবে গিয়েই হড়কে যাচ্ছে।”
“তা হলে আর একপো দিতে বলে দিই।”
“পাগল নাকি?”
“আপনার তো দেখছি পাখির আহার! না মশাই, আপনাকে খাইয়ে সুখ নেই। গেল হপ্তায় এই দোকানে বসেই বিপিন বিশ্বাসকে খাইয়েছিলাম, বললে বিশ্বাস করবেন না, দেড় সের রাবড়ি আর পঞ্চান্নটা ছানাবড়া চোখের পলকে উড়িয়ে দিল। ক্ষণজন্মা পুরুষ মশাই, সব ক্ষণজন্মা পুরুষ।”
খাওয়া শেষ হওয়ার পর নটবর পকেট থেকে একখানা রুপোর ডিবে বের করে বলল, “আমার মায়ের হাতে সাজা বেনারসি পাত্তির পান। এক খিলি ইচ্ছে করুন, দেখবেন মনটা ভারী ফুরফুরে হয়ে যাবে। মিষ্টি মশলা দেওয়া আছে।”
সনাতন হাত বাড়িয়ে পানটা নিয়ে মুখে পুরতে যাবে ঠিক এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটল। একটা মুশকো চেহারার লোক ঝড়ের বেগে দোকানে ঢুকে সটান তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বলল, “নিশিকান্ত! এটা কী ব্যাপার? কুমার বাহাদুরের শিকার তুমি কোন সাহসে দখল করে বসে আছ? তোমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?”
নটবর পালের বিনয়ের ভাবটা হঠাৎ উবে গেল। গলাটাও হয়ে উঠল ভারী গমগমে। হুংকার দিয়ে বলল, “আমি কে সেটা ভুলে যেয়ো না গদাধর। আমি কিংশুক গিরির ম্যানেজার।
“এ জিনিসের ওপর কিংশুক গিরির কোনও অধিকার নেই, ধর্মত ন্যায্যত ওটা কুমার বাহাদুরের পাওনা। ওই বাক্সের জন্য বহু খুনখারাপি হয়ে গেছে নিশিকান্ত, আরও কয়েকটা হলেও কুমার বাহাদুর পিছপা হবেন না।”
“বটে!” বলে নটবর পাল লাফিয়ে উঠে বলল, “তবে তাই হোক। আমিও তৈরি হয়েই এসেছি। বাইরে আমার দলবল রয়েছে।”
“দ্যাখো নিশিকান্ত, তুমি ভালই জানো যে, লড়াই হলে তুমি উড়ে যাবে। কুমার বাহাদুর রক্তপাত পছন্দ করেন না। তুমি ভালয় ভালয়
সরে পড়ো। আমি এ-লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।”
নটবর রুখে উঠে বলল, “খবরদার বলছি গদাধর। একদম ওসব চেষ্টা কোরো না।”
“তবে রে!” বলে গদাধর লাফিয়ে পড়ল নটবরের ঘাড়ে। নটবরও বড় কম যায় না। দেখা গেল সেও বিদ্যুৎগতিতে পাশে সরে গিয়ে লোকটার ঘাড়ে একখানা রদ্দা বসিয়ে দিল।
তারপর দুজনে চেয়ার টেবিল উলটে গেলাস পিরিচ ভেঙে ধুন্ধুমার লড়াই করতে লেগে গেল।
সনাতন দেখল, এই সুযোগ। মারপিট দেখতে লোকজন জড়ো হয়ে যাওয়ায় তার সুবিধেও হয়ে গেল খুব। সে উঠে পড়ি-কি-মরি করে বেরিয়ে ছুটতে লাগল।
তার মনে হল, চারদিক থেকে হঠাৎ একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে। এবং তার মূলে আছে সদ্য কেনা কাঠের বাক্সটা।
৩. তেমন দায়ে পড়লে দুর্গা মালো
তেমন দায়ে পড়লে দুর্গা মালো খুনখারাপি রক্তপাত করে বটে, কিন্তু তা বলে খুনটুন করতে সে ভালবাসে না। বিনা হাঙ্গামায় কার্যোদ্ধার হলেই সে খুশিই হয়, কিন্তু মুশকিলও সেইখানে। দুর্গা মালোর মাথায় তেমন বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। সূক্ষ্ম হাতের কাজেও সে দড় নয়। সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকার ধৈর্যও তার নেই। হাত সাফাইকারীদের মহলে তাই তার খুব বদনাম। সবাই বলে, দুর্গা মালোর হচ্ছে মোটা দাগের কাজ। এ-লাইনে তার গুরু হল পঞ্চানন পুততুণ্ড। পঞ্চাননও দুঃখ করে বলে, আমার চেলাদের মধ্যে দুর্গাটারই মাথা বড্ড মোটা। যত্ন করে সব শেখালাম, কিন্তু কিছুই তেমন শিখতে পারল না।
নিজের মধ্যে প্রতিভার অভাবটা দুর্গাও টের পায়। তাই সেটা সে গায়ের জোরেই পুষিয়ে নেয়।
মাধব পণ্ডিতের ট্যাঁক-ঘড়িটার কথাই ধরা যাক। কোমরে একটা রুপোর গোটের সঙ্গে চেন দিয়ে ঝোলানো থাকে। ইয়া বড় ঘড়ি। কোন
আদ্যিকালের কে জানে! এতকাল কারও নজরেও পড়েনি তেমন।
যুধিষ্ঠির বর্মনের বন্ধকি কারবার। একদিন দুর্গাকে ডেকে বলল, “মাধব পণ্ডিতের ট্যাঁক-ঘড়িটা যদি এনে দিতে পারিস তা হলে পঞ্চাশটা টাকা দেব।”
পঞ্চাশ টাকা শুনে দুর্গার মাথায় টিকটিকি ডেকে উঠল। মাধব পণ্ডিতের ট্যাঁক-ঘড়ির যে কোনও দাম আছে সেটাই তো কখনও মনে হয়নি। তাই দুর্গা মালোদর বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পঞ্চাশ টাকায় হবে না। একশো টাকা কবুল করলে এনে দেব।”
যুধিষ্ঠির গাঁইগুই করতে লাগল। অবশেষে রাজি হল বটে, কিন্তু হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলল, “খবরদার, মাধব পণ্ডিত যেন টের না পায়। হাল্লাচিল্লা, মারদাঙ্গার কাজ নয় বাপু। খুব সাবধানে কৌশলে কাজ হাসিল করা চাই।”
দুর্গা মালো ওস্তাদজিকে স্মরণ করে নেমেও পড়ল কাজে। হাতসাফাইয়ের বিস্তর তালিম নেওয়া আছে, কাজটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। কাটার যন্ত্র দিয়ে কোমরের রুপোর গোটটা কেটে ফেললেই হল। তারপর টুক করে টেনে নেওয়া। রুপোর গোটটা বেচেও কিছু পাওয়া যাবে।
মওকাও পাওয়া গেল জব্বর। গাঙপুরের গোঁসাই বাড়িতে কীর্তনের আসরে মাধব পণ্ডিত হল মধ্যমণি। কীর্তনটা গায়ও ভাল। আসরে ঢুকে অনেকের সঙ্গে দুর্গাও “হরিবোল হরিবোল” করে দু’হাত তুলে খানিকক্ষণ নাচল। মাধব পণ্ডিতের যখন বিভোর অবস্থা তখন সুযোগ বুঝে কোমরের গোটে কাটার ঢুকিয়ে কাটতে যাবে,