“তা মশাই, পুষ্যিপুতুর নিলেই তো পারেন।”
এ কথায় লোকটা শিউরে উঠে জিভ কেটে বলল, “ওকথা আর বলবেন না মশাই, খুব শিক্ষা হয়ে গেছে।”
“কেন, কী হয়েছিল?”
“পুষ্যিপুত্তুর নেব বলে সবে মনস্থির করছি, কী করে যে মনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কে জানে মশাই, হঠাৎ পালে পালে আন্ডাগন্ডা সব ছেলেপুলে হাজির হতে লাগল। কোনওটা হাবাগোবা, কোনওটা বদমাশ, কোনওটা মিটমিটে ডান। সব শিখিয়ে-পড়িয়ে আনা মশাই, সব শিখিয়ে-পড়িয়ে আনা। নিজের নাম হয়তো বলল সুজিত দাস, বাপের নাম বলল হারাণচন্দ্র মণ্ডল। এইসব দেখেশুনে ঘেন্না ধরে গেছে মশাই, ঘেন্না ধরে গেছে।”
গায়ে-পড়া নোকটাকে এড়ানোর জন্য সনাতন বলল, “আচ্ছা নটবরবাবু, আলাপ করে বড় খুশি হলাম। এবার তা হলে আমি যাই! বেলাও পড়ে আসছে।”
“আহা, তাড়াহুড়োর কী আছে মশাই, হাড়াহুড়োর কী? হাট হল মস্ত লোকশিক্ষার জায়গা। ভাল-মন্দ, বিষয়ী-বৈরাগী, সাধু-চোর, শাক্ত-বোষ্টম কতরকমের মানুষ আসে এখানে। ঘুরে বেড়ালেই কত কী শেখা যায়।”
সনাতন বিব্রত হয়ে বলে, “আজ্ঞে, তা বটে। তবে কিনা মানুষের তো খিদে-তেষ্টাও পায়।”
লোকটা একগাল হেসে বলে, “বিলক্ষণ! মানুষের শরীর বলে কথা, খিদে-তেষ্টা না পাওয়াই তো আশ্চর্যের বিষয়। কী বলেন?”
“তাই তো বলছি।”
“আমি আপনার সঙ্গে একমত। তবে দুঃখের কথা কী জানেন, খিদে-তেষ্টা আমারও পায়। একসময় পোলাও কালিয়া ছাড়া একবেলা চলত না। হাঁড়ি-হাঁড়ি রসগোল্লা উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন সব বারণ হয়ে গেছে মশাই। সব বারণ। পেঁপে দিয়ে শিং মাছের ঝোল আর মধুপর্কের বাটির এক বাটি ভাত ছাড়া আর পথ্যি নেই।”
“কেন মশাই?”
“ডাক্তাররা শরীরে নানারকম রোগের সন্ধান পেয়েছে। বেশি খেলেই নাকি মৃত্যু অনিবার্য। তাই তো বলছি মশাই, আমার কি দুঃখের শেষ আছে! এত টাকা, এত ঐশ্বর্য, এত খাবারদাবারের আয়োজনের মধ্যে দাঁতে কুটো কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। সেই যে কথায় বলে, সানকিতে বজ্রাঘাত, এ হল তাই। কথাটা কি ঠিক বললুম?”
“বোধ হয় ঠিকই বলেছেন। এবার আমি আসি তা হলে।”
লোকটা ভারী করুণ মুখ করে তার দিকে চেয়ে থেকে একটু মিয়োনো গলায় বলল, “চলে যাবেন? এত বড় একটা সুযোগ আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেবেন? আপনাকে তো তেমন পাষণ্ড বলে মনে হয় না!”
সনাতন থতমত খেয়ে বলে, “আজ্ঞে, কোন সুযোগের কথা বলছেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না!”
লোকটার চোখ ছলছল করতে লাগল। ধরা গলায় বলল, “সুযোগ বলে সুযোগ! ব্রাহ্মণ ভোজন করালে সাতজন্মের পাপ কেটে যায় মশাই! ভেবেছিলাম আপনাকে পেয়ে সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে খানিকটা পুণ্যি করে নেব! শুধু পুণ্যিই তো নয়। নিজে খেতে পারছি না বলে অন্যকে খাইয়ে আমার একটা সুখ হয়! আর আপনি আমাকে বঞ্চিত করে চলে যেতে চাইছেন!”
সনাতনের একগাল মাছি। সে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে আপনার খুবই ভুল হচ্ছে। আমি ব্রাহ্মণ নই!”
নটবর পাল একগাল হেসে বলল, “সৎ ব্রাহ্মণরা কি সহজে ধরা দিতে চায়! আর ছলনা করবেন না মশাই, আপনাকে দেখেই চিনেছি।”
“কী মুশকিল! আপনি তো আমার নামটাও জানেন না।”
“নামে কী আসে যায় বলুন। আলু, পটল, মুলো, নাম একটা হলেই হল। ও নিয়ে ভাববেন না। এই তো কাছেই রামগোপালের দোকান। পোটাক রাবড়ি আর কয়েকখানা গরম ছানাবড়া ইচ্ছে করুন, এই অধমকে এটুকু দয়া যে আজ করতেই হবে। ইদানীং পাপের দিকে পাল্লাটা আমার বেশ ঝুলে পড়েছে বলে টের পাচ্ছি, একটু হালকা হতে দিন।”
রামগোপালের রাবড়ি আর ছানাবড়া সনাতনের বড়ই প্রিয় জিনিস। বড় লোভে ফেলে দিল লোকটা। তবু সনাতন আমতা আমতা করে বলে, “কিন্তু মশাই, আমাকে খাওয়ালে আপনার পাপটাপ কাটবে না, এই বলে রাখছি।”
লোকটা হুংকার দিয়ে বলে, “কে বলল কাটবে না! আলবাত কাটবে। পাপের বাবা কাটবে। এই তো ছয় মাস আগে নকুল ভটচামশাইকে এক হাঁড়ি দই আর ছাপ্পান্নটা রসগোল্লা খাওয়ালুম। বললে বিশ্বাস করবেন না মশাই, দইয়ের হাঁড়ি সাফ হচ্ছে আর শরীরও হালকা হচ্ছে। শেষে যখন রসগোল্লা খাচ্ছেন তখন টপাটপ রসগোল্লা যেই গলা দিয়ে নামছে আমার শরীরটা যেন ফুরফুর করতে লেগেছে। শেষে পাপ যখন চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমাকে ছেড়ে চলে গেল তখন শরীর একেবারে পালকের মতো হালকা, এত হালকা যে মেঝে ছেড়ে দেড় হাত শূন্যে উঠে পড়ল। তখন আমিই ভটচামশাইকে থামালুম, আর না, আর না ভটচামশাই! এরপর যে গ্যাস বেলুনের মতো উড়ে যাব। তা উনি তখন বিরক্ত হয়ে ওই ছাপ্পান্নটাতেই থামলেন। নইলে বিপদ ছিল।
“কী মুশকিল! আমি যে মোটেই বামুন নই। এই দেখুন, আমার গলায় পইতেও নেই।”
লোকটা একগাল হেসে বলে, “চেনা বামুনের পইতে লাগে না। আসুন মশাই, আসুন। হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। পাপ কাটে কি না হাতেকলমে দেখিয়ে দিচ্ছি।”
সনাতনের ভারী সংকোচ হচ্ছিল। লোকটা পাগলই হবে। তবে সে আর গাঁইগুই করল না। পকেটে পয়সা নেই, খিদেটাও চাগাড় দিয়েছে। ভগবান কখনও সখনও গরিবকে এভাবেই হয়তো অযাচিত সাহায্য করেন।
রামগোপালের রাবড়ি হল সরে দুধে মাখামাখি, ওপরে ননি ভেসে থাকে। মুখে দিলেই মনে হয়, স্বর্গে উঠে গেলাম। লোকটা দিলদরিয়া আছে। একপো রাবড়ি আর দশখানা ছানাবড়া হুকুম দিয়ে বসল।