“না হে বাপু, ওসব মনেটনে নেই।” বেঁটে লোকটা ভারী বিমর্ষ হয়ে চারদিকে হতাশভাবে একবার তাকিয়ে গুটিগুটি চলে গেল।
দানু নির্বিকার বসে রইল। আরও আধঘণ্টা বাদে বেশ মুশকো চেহারার একটা লোক এসে হাজির। এ-লোকটাই পাঁচশো টাকা দর দিয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ল দানুর।
লোকটা এসেই কোটের ভেতরের পকেট থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট বের করে হাজার টাকা গুনে দানুর দিকে বাড়িয়ে বলল, “দিন দাদু, বাক্সটা দিন। হাজার টাকাই দিচ্ছি।”
দানু বিরক্ত হয়ে বলে, “আর হাজার টাকা দেখিয়ে লাভ নেই। বাক্স বিক্রি হয়ে গেছে।”
লোকটা চোখ পাকিয়ে বলে, “তার মানে?”
দানু তেতো গলায় বলে, “বাংলা ভাষাতেই তো কথা বলছি বাপু, তাও মানে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে কেন? বাক্স বিক্রি হয়ে গেছে।”
লোকটা হঠাৎ চাপা একটা হুংকার দিয়ে বলে, “কে কিনেছে?”
“তার আমি কী জানি? খদ্দেরের ঠিকুজি কুষ্ঠি রাখা তো আমার কাজ নয়।”
“চালাকি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন না তো!”
দানু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “এ দোকানে দাম বাড়ানোও হয় না, কমানোও হয় না। যাও বাপু, পথ দ্যাখো।”
লোকটা হঠাৎ একটু হাসল। খুবই রহস্যময় হাসি। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, “আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে প্রতাপগড়ের মেজোকুমার এক রাতে ঘোড়া দাবড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। পুরনো গড়ের কাছে তাঁকে বল্লম চালিয়ে খুন করা হয়। মনে পড়ে?”
দানু বিস্ফারিত চোখে লোকটার দিকে চেয়ে রইল। জবাব দিল না। লোকটা ফের বলল, “গদাধরপুরের মস্ত মহাজন শঙ্কর শেঠকে কীভাবে খুন করা হয়, মনে আছে? জানলা দিয়ে তির ছুঁড়ে।”
দানু বিব্রত হয়ে একটা ঢোক গিলল। তাচ্ছিল্যের ভাবটা উবে গেছে।
“আরও বলব? হবিবপুরের ব্রজেন মাস্টারের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। কিন্তু সবাই জানে, সে সময়ে মোহিত দাসের সঙ্গে বদ্বীপ্রসাদের মামলায় ব্রজেন মাস্টার ছিল মোহিতের সাক্ষী। সে সাক্ষী দিলে বদ্রীপ্রসাদ অবধারিত হারে। তাই সাক্ষী দেওয়ায় আগের রাতে ব্রজেন মাস্টারকে সাপে কামড়ায়। আসলে সাপে কামড়ায়নি, সাপকে দিয়ে কামড়ানো হয়েছিল।”
দানু ফেজ টুপিটা খুলে ফের পরল। একটু বিড়বিড় করল আপনমনে।
“এসব ভাল ভাল কাজের পেছনে কার হাত ছিল জানেন? মছলন্দপুরের দানু হেস। পুলিশ তাকে কখনও ধরতে পারেনি অ্যারেস্ট করেও প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।”
দানু গলার মাফলারটা খুলে আবার জড়িয়ে নিল। লোকটার চোখে আর চোখ রাখছিল না।
“দানু হেসের আরও গুণের কথা শুনবেন? প্রথম জীবনে চুরি, ডাকাতি ছিনতাই করে সে দু পয়সা কামাত। মোটা টাকা পেলে খুনখারাপি করত। বয়স হওয়ার পর সে চোরাই জিনিসের ব্যবসা খুলেছিল। জীবনেও এসব কাজের জন্য সে কোনও সাজা পায়নি। ভারী চালাক-চতুর ছিল সে। তা বলে ভাববেন না যে, তার শত্রুর অভাব আছে। তাকে পেলে আজও তাকে খুন করার জন্য কিছু লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। বুঝেছেন?”
দানু মুখটা নিচু করে খানিক বিড়বিড় করল। তারপর লোকটার দিকে না তাকিয়েই বলল, “এত কথা হচ্ছে কেন?”
“বলি বাক্সটা কে কিনেছে?”
“মাধবগঞ্জের সনাতন রায়।”
“কীরকম পোশাক?”
“ধুতি, গায়ে আলোয়ান, কাঁধে সবুজ রঙের ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে বাক্সটা আছে।”
“আলোয়ানের রং কী?”
“নস্যি রঙের।”
“চেহারা?”
“ফরসা, রোগা, লম্বামত। মাথায় কোঁকড়া চুল। নাকের বাঁ পাশে বড় আঁচিল আছে।”
“ঠিক আছে। খুঁজে তাকে পাবই।”
“একটা কথা বাপু।”
“কী কথা?”
“তুমি কে?”
“আমি তোমার যম। সময়মতো তোমার সঙ্গে দেখা হবে। ভেবো।”
বলে লোকটা চলে গেল। দানু বিফল হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর ধীরেসুস্থে দোকান গোটাতে লাগল। না, তার আজ মেজাজটা ভাল নেই।
খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে সনাতনের খিদে পেল। ঝিকরগাছার হাটে এলে রামগোপাল ময়রার দোকানে ছানাবড়া আর রাবড়ি তার বাঁধা। কিন্তু আজ বাক্সটা কিনতে গিয়ে পয়সা সব বেরিয়ে যাওয়ায় সেসব আর খাওয়া হবে না। সে গুটিগুটি তেলেভাজার দোকানের দিকে এগোতে লাগল।
ঠিক এই সময়ে ভারী অমায়িক চেহারার গোলগাল একজন লোক তার সামনে ফস করে উদয় হয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আরে! মুখোনা যে বড় চেনা চেনা লাগছে!”
সনাতন লোকটাকে ঠাহর করে দেখেও ঠিক চিনতে পারল না। বলল, “আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না। কে বলুন তো আপনি?”
“আমাকে চিনলেন না! আমি হলুম পিরগঞ্জের নটবর পাল।”
খানিকক্ষণ ভেবে সনাতন মাথা নেড়ে বলে, “না মশাই, নটবর পাল নামে কাউকে মনে পড়ছে না তো! পিরগঞ্জও আমার চেনা জায়গা নয়।”
“হতে পারে মশাই, খুবই হতে পারে। তবে আমার বড় শালা হল গে কালিকাপুরের দারোগা গণেশ হালদার।”
সনাতন মাথা নেড়ে বলল, “ চিনি না।”
“তাও চিনলেন না! তবে বলি মশাই, ঝিকরগাছার হাটে প্রতি পাঁচজন লোকের একজন জানে যে, নটবর পালের তামাক আর ভুসিমালের কারবারে লাখো লাখো টাকা খাটছে মশাই, লাখো লাখো টাকা। তা বলে কি আর মনে সুখ আছে মশাই? কোনও সুখ আছে?”
সনাতন অবাক হয়ে বলে, “তা সুখ নেই কেন?”
“সুখ থাকবে কী করে বলুন! সুখ তো আর চাকরবাকর নয় যে, ডাকলেই জো হুজুর বলে এসে হাজির হবে! আমারটা খাবে কে বলুন তো! কে খাবে আমারটা? আমার ছেলেপুলে নেই, ওয়ারিশন নেই। আছে শুধু টাকার পাহাড়। তাই তো মাঝে-মাঝে নিশুত রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসে বলি, ওরে নটবর, তোর এই বিষয়সম্পত্তি কাকে দিয়ে যাবি বাপু? তোর কে আছে?”