বড় করে পাতা একটা ত্রিপলের ওপর সাজানো পসরা। এক কোণে দানু গম্ভীর মুখে চুপচাপ বসা। সনাতন একটা পুরনো বিবর্ণ চটি বই উলটেপালটে দেখছিল। বইটার নাম, সশরীরে অদৃশ্য হইবার কৌশল। সেখানা রেখে আর একখানা বই তুলল সে, শূন্যে ভাসিয়া থাকিবার সহজ উপায়।
“এসবে কি কাজ হয় দানুজ্যাঠা?”
দানু বিরস মুখে বলে, “কে জানে বাপু। আমি বই বেচে খালাস, কাজ হয় কি না তা বই যে লিখেছে তার সঙ্গে বুঝে নাওগে।”
দানুর ওরকমই ক্যাটকেটে কথা। বই রেখে সনাতন অন্যসব জিনিস দেখতে লাগল। হরেক জিনিস। ছোট-বড়-ভাঙা-আস্ত নানা আকৃতি আর প্রকৃতির জিনিস। পুরনো কলম আর দোয়াতদানি, জং ধরা ছুরি, বাহারি হাতপাখা–দেখতে দেখতে সনাতনের মাথা টাল খায়। একধারে ভঁই হয়ে থাকা রাবিশের মধ্যে সনাতন একটা কাঠের বাক্স দেখে সেটা টেনে আনল। বেশ ভারী বাক্স। ইঞ্চিদশেক লম্বা, সাত ইঞ্চির মতো চওড়া, আর চার ইঞ্চির মতো পুরু।
“এবাক্সে কী আছে দানুজ্যাঠা?”
“তা কে জানে বাপু। আমি খুলে দেখিনি?”
“দ্যাখোনি! সোনাদানাও তো থাকতে পারে।”
“তা থাকলে আছে।”
“দেখার ইচ্ছে হয়নি?” দানু বিরস মুখে বলে, “তা সোনাদানা থাকলেই বা আমার কী? আমার তিনকুলে কেউ নেই, তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। সোনাদানা দিয়ে আমার আর হবেটাই বা কী, বলো তো বাপু!”
সনাতন বাক্সটা খোলার চেষ্টা করছিল।
দানু নিস্পৃহ চোখে চেয়ে দেখে বলল, “ওভাবে কি খোলে রে বাপু। গা-তালা যে আটকানো আছে।”
“তা হলে চাবিটা দিন।”
“চাবি থাকলে তো আমিই খুলতুম। চাবিটাবি নেই। বন্ধ বাক্সটাই শুধু পেয়েছি। কিনতে চাইলে কিনতে পার, তবে হাজার টাকা দাম পড়বে।”
চোখ কপালে তুলে সনাতন বলে, “হাজার?”
“হ্যাঁ, বাপু। ভেতরে সোনাদানা থাকলেও তোমার। ইটপাটকেল থাকলেও তোমার।”
সনাতন বাক্সটার গায়ের ময়লা রুমালে একটু ঘষে পরিষ্কার করে নিয়ে দেখল, কালচে কাঠের ওপর নানা নকশা খোদাই করা আছে। এক-দেড়শো বছরের পুরনো তো হবেই।
সনাতন ভারী দোনোমোনোয় পড়ে গেল। হাজার টাকা অনেক টাকা। ভেতরে ইটপাটকেলই যদি থাকে তা হলে শুধু বাক্সটার দামই হাজার টাকা পড়ে যাচ্ছে। খুবই ঠকা হয়ে যাবে।
কিন্তু কৌতূহল বড়ই বলবতী। বন্ধ বাক্সয় কী আছে তা জানার অদম্য কৌতূহলও তাকে পেড়ে ফেলল। “কিছু কমসম হয় না দানুজ্যাঠা?” দানু পাথরের মতো নির্বিকার মুখ করে বলল, “কখনও দেখেছ এক পয়সাও দাম কমিয়েছি? এসব জিনিসের তো বাপু কোনও বাঁধাধরা দাম নেই। যার শখ চাপে সে কেনে। তাতে সে ঠকতেও পারে, জিততেও পারে। দাম কমাতে পারব না বাপু। ওই হাজার টাকাই দিতে হবে।”
সনাতন হিসেব করে দেখল, কুড়িয়ে বাড়িয়ে তার কাছে হাজার টাকা হয়ে যাবে বটে, কিন্তু বাড়তি পয়সা কিছুই প্রায় থাকবে না। এবার চেপে শীত পড়েছে, সইফুলের দোকান থেকে একখানা ফুলহাতা সোয়েটার কিনবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। এক শিশি গন্ধ তেল কেনারও শখ ছিল। একজোড়া চটিও না কিনলেই নয়। তা বাক্স কিনলে আর সেসব কেনা হবে না। বড়জোর এক কাপ চা আর দুটি শিঙাড়ার পয়সা পড়ে থাকবে পকেটে।
সনাতন ভারী বেজার মুখে গেঁজে থেকে হাজারটা টাকা বের করে দানুকে দিয়ে বলল, “বাক্স থেকে কী বেরোবে কে জানে! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, বুঝলেন দানুজ্যাঠা?”
দানু হাজারটা টাকা আলগোছে নিয়ে আলখাল্লার পকেটে সাঁদ করিয়ে বলল, “তা বাপু, পরে আবার আমাকে দোষ দিয়ো না। কেনার জন্য তো তোমাকে মাথার দিব্যি দিইনি।”
“না দানুজ্যাঠা, আপনার আর দোষ কী?”
“ওবাক্সের জন্য আরও দু’জন এসে ঘুরে গেছে। একজন তিনশো অবধি উঠেছিল, অন্যজন পাঁচশো দিতে চেয়েছিল। আমি সাফ বলে দিয়েছি, এ-দোকানে দরাদরি হয় না। আমার দামে নিতে হয় নাও, নইলে কেটে পড়ো।”
সনাতন বাক্সখানা তার ঝোলাব্যাগে পুরে নিয়ে উঠে পড়ল। মনটা খচখচ করছে। হাজার টাকা বোকাদণ্ডই গেল আজ!
সনাতন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বেঁটেমতো রোগাপানা চেহারার একটা লোক এসে বেজার মুখে দানুকে বলল, “দিন দাদা, বাক্সখানা দিন। তিনশো বলেছিলাম, আরও না হয় দুশো দিচ্ছি।”
দানু ছোট চোখ করে লোকটাকে দেখে বলল, “বাক্স! বাক্স তো বিক্রি হয়ে গেছে।”
লোকটা চমকে উঠে বলে, “অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ হে, বিক্রি হয়ে গেছে।”
“কেন ছল-চাতুরি করছেন মশাই? না হয় আরও একশো টাকা দিচ্ছি। বড় পছন্দ হয়ে গেছে বাক্সখানা।”
দানু বিরস মুখে বলে, “মেলা ঘ্যানঘ্যান কোরো না তো বাপু। তোমার মুরোদ জানা আছে। বাক্স হাজার টাকাতেই বিক্রি হয়েছে। এবার কেটে পড়ো।”
লোকটা হঠাৎ মাথায় দু’হাত চেপে বসে পড়ল। বলল, “সর্বনাশ!”
দানু তেরছা চোখে লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, “কেন হে, সর্বনাশের কী হল?”
লোকটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, “কে কিনেছে বলতে পারেন?”
“তা কে জানে! কত খদ্দের আসে, আমি কি সবার নাম-ঠিকানা লিখে রাখি?”
“আহা, চেহারাটা কেমন সেটা তো বলতে পারেন!”
“চেহারারই বা ঠিক কী? হাটে কত লোক, সকলের চেহারা আলাদা করে মনে রাখা কি সোজা? আমি বুড়োমানুষ, চোখেরও জোর নেই, মনেও থাকে না।”
“সর্বনাশ হয়ে যাবে মশাই, একেবারে সর্বনাশ। আচ্ছা, লোকটার বয়স কত?”
“চব্বিশ-পঁচিশ হবে বোধ হয়।”
“ফরসা না কালো?”
“ফরসার দিকেই।”
“ইয়ে, তার নামটা কি মনে আছে?”