লালু এসে বলল, “ওস্তাদজি, মেয়ে কাটার খেলাটা ফের চালু করুন, ওটা লোকে খুব নেয়।”
ভজহরি খিঁচিয়ে উঠে বলে, “কচু নেয়। তা ছাড়া মেয়েই বা পাব কোথায়? ও খেলা দেখাতে যন্ত্রপাতি চাই, লোকলশকর চাই। পাব কোথা?”
চোখ বেঁধে তিরন্দাজির একটা জব্বর খেলা দেখাতেন বলে শুনেছি। একটা বাচ্চা মেয়ের মাথায় আপেল রেখে দূর থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় তির ছুঁড়ে আপেল গেঁথে ফেলতেন। সেটা ফের চালু করলে হয় না!”
হতাশ ভজহরি মাথা নেড়ে বলে, “না হে বাপু, ওসব আর আমার আসে না।”
খেলাটা শুনতে যত বিপজ্জনক আদতে ততটা নয়। স্টেজের এ-মুড়ো ও-মুড়ো টান টান করে একটা সরু আর শক্ত কালো সুতো বাঁধা থাকত। তির আর আপেল দুটোই পরানো থাকত সুতোর দু’ প্রান্তে। তির ছাড়লে সেটা সুতো বেয়ে গিয়ে আপেলটা গেঁথে ফেলত। সে আমলের বোকাসোকা লোকেরা খেলা দেখেই খুশি, কলকৌশল নিয়ে মাথা ঘামাত না। আজকালকার চালাক-চতুর লোককে বোকা বানানো সহজ নয়।
তবে খেলাটা দেখাতে গিয়ে একবার নিজেই বড় বোকা বনে গিয়েছিল ভজহরি। তখন তার খুব নামডাক। গঙ্গাধরপুরের রাজবাড়ির রাস উৎসবে খেলা দেখাতে গিয়েছিল সেবার। রাজা পুরন্দরচন্দ্র বাহাদুর, রাজকুমার রাজেন্দ্রচন্দ্র, মহেন্দ্রচন্দ্র, হরিশচন্দ্র, রানিমা, বউরানিরা সবাই উপস্থিত। বিরাট আসর। তখন ভজহরির মেয়ে হিমি মাথায় আপেল নিয়ে দাঁড়াত। তা সেবার হল কী, হিমি দাঁড়িয়েছে, ভজহরিও চোখবাঁধা অবস্থায় ধনুকে তির লাগিয়ে ছিলা টেনেছে। ঠিক সেইসময়ে পুটুং করে শব্দ করে সুতোটা ছিঁড়ে গেল। আর ভজহরি এমন ঘাবড়ে গেল যে, ভুল করে তিরটাও ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিয়েই মাথা চেপে বসে পড়ল। এ কী সব্বোনেশে কাণ্ড করল সে!
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, হলে তুমুল হাততালি পড়ছিল। ভজহরি চোখের ফেট্টি খুলে দেখে, মেয়ে দিব্যি হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। আর আপেলটা উইংসের পাশে তিরবেঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ ওরকম হওয়ার কথাই নয়।
গঙ্গাধরপুরের সেই আসরে আরও অনেক কাণ্ড হয়েছিল। লোকে ম্যাজিক মনে করে হাততালি দিয়েছিল বটে, কিন্তু একমাত্র ভজহরিই জানে যে, সেগুলো মোটেই ম্যাজিক ছিল না। ব্যাপারটা
সে নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
নদুয়া বলল,”লোকের মুখে মুখে আপনার ভূত নাচানোর খেলার কথাও খুব শোনা যায়। বলছিলাম কি ওস্তাদজি, সেগুলো ফের ঝালিয়ে তুললে হয় না?”
ভজহরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সেই রাবণও নেই, সেই লঙ্কাও নেই, বুঝলি! এবার আমার রিটায়ার করার সময় হয়েছে।”
নদুয়া ডুকরে উঠে বলে, “তা হলে আমাদের কী হবে?”
“তোর মতো অপদার্থের কিছু হওয়ার নয়।” বিকেলের শোয়ের সময় হয়েছে। ভজহরি মুখটুখ মুছে জল খেয়ে তৈরি হল।
লালু এসে উত্তেজিত গলায় বলল, “ওস্তাদজি, হাউস ফুল!”
“তার মানে?”
“দেড়শো টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তাঁবুর ভেতরে আর জায়গা নেই।”
“বলিস কী?” অবাক কাণ্ডই বলতে হবে।
পরদা সরানোর পর ভজহরিও দেখল, কথাটা মিথ্যে নয়। তাবুর ভেতরে বিস্তর মানুষ জুটেছে। সর্বাগ্রে তার নজর পড়ল, একদম সামনে শতরঞ্জির ওপর খুব রাজাগজা চেহারার একজন লোক বসে আছে। হাতে হিরের আংটি, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, চুনোট করা ধুতি, মস্ত গোঁফ, চেহারাখানাও দেখার মতো। ভিড়ের মধ্যে অল্প আলোয় ভজহরি দুর্গা মালো, রসো পান্তি এবং আরও দু-চারজন সন্দেহজনক চরিত্রকেও দেখতে পাচ্ছিল। চুরি ছিনতাই রাহাজানি করে বেড়ায়।
ভজহরি খুশি হয়ে খেলা দেখাতে শুরু করল।
২. সনাতন রায় আর পাঁচটা হাটুরের মতো নয়
সনাতন রায় আর পাঁচটা হাটুরের মতো নয়। সে হাটে আসে সব বিটকেল জিনিস কিনতে। ওই তার এক বাতিক। যে জিনিস কারও কাজে লাগে না, যেসব জিনিস লোকে ফিরেও দেখে না, সেগুলিই গাঁটগচ্চা দিয়ে সে কিনে নিয়ে যায়। তা বলে সনাতন যে পয়সাওলা লোক তাও নয়। পয়সাওয়ালাদের পয়সা ওড়ানোর জন্য অনেক বাতিক জন্মায়। সনাতন নিতান্তই সামান্য একজন গরিব গোছের মানুষ। মাধবগঞ্জের বাজারে তার একখানা ছোটখাটো মনোহারি দোকান আছে। ব্যবসা ভাল চলে না। তবে সনাতনের কোনওক্রমে চলে যায়। তিনকুলে তার কেউ নেই। বুড়ি মা এতদিন বেঁচে ছিল, এই তো ছ’মাস আগে মাও মারা যাওয়ায় সনাতনের ঝাড়া হাত-পা। দোকানের পেছনেই তার দু’খানি ঘর, বারান্দা আর উঠোন নিয়ে একখানা বাড়ি। সেই ঘর দু’খানায় গেলে লোকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। চিনেলণ্ঠন, ভাঙা পুরনো শেজবাতি, পুরনো পেতলের পিলসুজ, বহু পুরনো আবছা-হয়ে-আসা অয়েল পেন্টিং, তুলোট কাগজ আর তালপাতার কিছু পুঁথি, ব্রিটিশ আমলের পুরনো সেন্টের খালি শিশি, নাগাদের তির-ধনুক, দোয়াতদানি, অচল পয়সা কী নেই তার ঘরে! কেন এসব সে জমায়, জিজ্ঞেস করলে সনাতন কেবল লজ্জার হাসি হাসে। বিটকেল জিনিস কেনা ছাড়া তার আর কোনও শখ-আহ্লাদ নেই।
ঝিকরগাছার এই হাটে একজন দোকানদারের কাছেই সে আসে। সে হল মাথায় ফেজ টুপিওলা, জোব্বা পরা প্রায় নব্বই বছর বয়সের এক বুড়ো। তার নাম দানু।
দানুর দোকানে পুরনো বই, ছবি, পুঁথি, নানা জায়গার রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ির পরিত্যক্ত জিনিসপত্র থাকে। বেশিরভাগই অকাজের জিনিস। খদ্দেররা এসে সেসব নাড়াঘাটা করে বটে, কিন্তু দাম শুনে পিছিয়ে যায়। হ্যাঁ, দানুর জিনিসের দাম বেশ চড়া। তার ওপর সে বেজায় বদমেজাজিও বটে। মেজাজ দেখেও খদ্দেররা হটে যায়।