আর রাজারা একে একে উঠে দাঁড়িয়ে একে একে তার দিকে হেঁটে আসতে লাগলেন। ভজহরি যন্ত্রচালিতের মতো কাঁপা হাতে টুপিটা খুলে উলটে ধরল সামনে। গম্ভীর মুখে রাজারা টুং টাং করে মোহর ফেলে যেতে লাগলেন টুপির মধ্যে। ঠিক বারোটা মোহর। তারপর ধীর পদক্ষেপে তাঁরা হেঁটে যেতে লাগলেন সিঁড়ির দিকে।
কুমার বাহাদুর বিদ্যুৎগতিতে এসে ভজহরির হাত থেকে টুপিটা কেড়ে নিয়ে মোহরগুলি দেখে গর্জন করে উঠলেন, “মোহর। মোহর! সিঁড়িটা কোথায়… সিঁড়িটা..?”
ভজহরি হাত তুলে দেখাল, “ওই যে।”
ভজহরির হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে কুমার বাহাদুর ছুটতে লাগলেন, “সিঁড়িটা দেখাও ভজহরি…সিঁড়িটা আমার চাই…”
আশ্চর্যের বিষয়, সিঁড়িটা আজ মিলিয়ে গেল না। সকলের চোখের সামনে সিঁড়িটা দিব্যি দেখা যেতে লাগল। সিঁড়ির মাথায় কারুকাজ করা দরজাটাও।
ভজহরিকে একটা ঠেলা দিয়ে কুমার বাহাদুর বললেন, “ওঠো, ওঠো ভজহরি, পথ দেখাও।”
কাঁপতে কাঁপতে ভজহরি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। পেছনে কুমার বাহাদুর, তার পেছনে কুমার বাহাদুরের দলবল।
বারোজন রাজা মিলিয়ে গেছেন দরজার ভেতরে। তবু দরজা আজ খোলা। যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
ভজহরির পেছন পেছন কুমার বাহাদুর আর তার দলবল হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে লাগল। শেষজন ঢুকে যাওয়ার পর দরজাটা আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল দরজা আর সিঁড়ি।
অনেকক্ষণ কেউ কথা কইতে পারল না। সবাই স্তম্ভিত, বজ্রাহত, বাক্যহারা।
হঠাৎ রানিমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “ওগো, আমার নবেন কোথায় গেল!নবেনের কী হল! ওরে বাবা, আমি যে নবেনকে ছাড়া প্রাণে বাঁচব না। ওগো, আমার নবেনকে শিগগির ফিরিয়ে আনন…”
হঠাৎ লম্বা, ছিপছিপে, গৌরবর্ণ সাধুটি ধীর পায়ে দরবার ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। গায়ে সেই বিলিতি কম্বল।
রানিমা তার কাছে ছুটে গিয়ে কেঁদে পড়লেন, “ও সাধুবাবা, তোমার পায়ে পড়ি, একটা কিছু করো। আমার নবেন কোথায় গেল…”
সাধুটি একটু হাসল মাত্র। তারপর দুই সবল হাতে রানিমাকে ধরে বলল, “শান্ত হও মা, শান্ত হও…”
রাজা মহেন্দ্র একটু গলাখাঁকারি দিয়ে ডাকলেন, “তা ইয়ে, শ্রীদাম আছ নাকি হে!”
“যে আজ্ঞে মহারাজ।” বলে সিংহাসনের পেছন থেকে শ্রীদাম বেরিয়ে এল।
রাজা মহেন্দ্র বললেন, “তা ইয়ে, বাপু শ্রীদাম, এবার তা হলে জড়লটার একটা সুলুকসন্ধান না করলেই যে নয়! সেটা যথাস্থানে আছে তো?”
“যে আজ্ঞে মহারাজ। সাধুবাবা গা থেকে কম্বলটা নামালেই হয়।”
একটু বাদে যখন সাধুর বাঁ বগলের নীচে জডুলটার সন্ধান পাওয়া গেল, তখন মহেন্দ্র সখেদে বললেন, “জঙুল তো যথাস্থানেই আছে দেখছি হে শ্রীদাম। কিন্তু তোমাদের রানিমার আবার পছন্দ হলেই হয়।”
সাধুকে কোলে টেনে নিয়ে রানিমা কেঁপে কেঁপে কাঁদছিলেন, “ছিঃ বাবা, মাকে কি এত ছলনা করতে হয়! কী ছিরি হয়েছে চেহারার! একমুখ দাড়ি-গোঁফ! আর শীতে কত কষ্ট পেয়েছিস বাবা! কতকাল পেটভরে খাসনি বল তো! তা বাবা এবার আমি ঘটিবাটি বেচে হলেও তোকে দু’বেলা পেটভরে খাওয়াব।”
শ্রীদাম একটা গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “রানিমা, ঘটিবাটি না বেচলেও চলবে।”
রাজা মহেন্দ্র মৃদুস্বরে বললেন, “গুপ্তধন নাকি হে!”
“একরকম বলতে পারেন।” বলে সিংহাসনের পেছন থেকে একখানা কারুকাজ করা ভারী বাক্স নিয়ে এসে সামনে রেখে বলল, “মোট পাঁচশোখানা আছে।”
“এই সেই লোচনের বাক্সখানা নাকি?”
“যে আজ্ঞে মহারাজ।”
“তা ইয়ে, শ্রীদাম।”
“যে আজ্ঞে।”
“এই নবেনকেও যে তোমার রানিমার বেশ পছন্দ।”
“তাই দেখছি মহারাজ।”
“তা নতুন নবেনকে বলল যেন ঘামাচি হলে জডুলটা আবার না চুলকোয়।”