“তোমার দোষ হল, এক একবার উদয় হয়ে তুমি আমার মাথায় নতুন নতুন সমস্যা ঢুকিয়ে দিয়ে যাও। আটান্ন যে আমার হাঁটুর বয়স! আমি কি আমার চেয়ে এতটাই ছোট! এই হারে যদি বয়স কমিয়ে ফেলতে থাক বাপু, তা হলে তো একদিন দেখব আমি আমাকেই কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
জিভ কেটে নিজের দু’কান ছুঁয়ে শ্রীদাম বলল, “আস্পদ্ধা মাফ করে দেবেন মহারাজ। তা হলে হাঁটু প্রতি আটান্ন করে ধরে দুই হাঁটু যোগ করলে একুনে আপনি যে বয়সটা চাইছেন তাই গিয়ে দাঁড়ায় বোধ হয়।”
“তুমি বড়ই অর্বাচীন।”
“যে আজ্ঞে।”
রাজা মহেন্দ্র একটু হাসলেন।
শ্রীদাম একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, “মহারাজ!”
“বলে ফেলো বাপু।”
“বলি কাজটা কি উচিত হচ্ছে?”
“কোন কাজটা হে বাপু?”
“একটু আগে আসার পথে দেখলুম, মহারানিমা একখানা বিলিতি কম্বল নিয়ে গিয়ে বটতলার সাধুটাকে দিয়ে এলেন। এতে কি রাজকুমার নবেন্দ্র কুপিত হবেন না?”
“অ্যাঁ!” বলে রাজা মহেন্দ্র সোজা হয়ে বসলেন, “দিয়ে এসেছে?”
“শুধু কি তাই মহারাজ! সঙ্গে একথালা মিষ্টিও।”
“বল কী হে! ঠিক শুনছি তো!”
“যে আজ্ঞে মহারাজ। বলছিলাম কাজটা কি ঠিক হচ্ছে!”
“তা ইয়ে, শ্রীদাম।”
“আজ্ঞা করুন মহারাজ।”
“ইয়ে, ওই জডুলটা এখনও স্বস্থানেই আছে তো!”
“আজ্ঞে মহারাজ, জড়ল একচুলও নড়েনি, নড়ার লক্ষণও নেই।”
স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে মহেন্দ্র বললেন, “ওই জডুলটা নিয়েই চিন্তা, বুঝলে শ্রীদাম।”
“বুঝেছি মহারাজ।”
.
রাজকুমার নবেন্দ্র দরবার ঘরে সন্ধেবেলা ম্যাজিক শোর আয়োজন করেছেন। তাঁর হুকুমে বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে। রাজা মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে আছেন। পাশে জলচৌকিতে রানিমা। মেঝের ওপর শতরঞ্চিতে নবেন্দ্রর দলবল। বাঁ ধারে আরেকটা ফাঁকা চেয়ার সাজিয়ে রাখা।
একধারে স্টেজ সাজানো হয়েছে। নিবু নিবু আলো জ্বলছে চারদিকে। কেমন একটা ভুতুড়ে ভাব।
হঠাৎ এই ম্যাজিক শোয়ের আয়োজন কেন তা রাজা মহেন্দ্র বুঝতে পারছিলেন না। আবার যেন আবছা আবছা একটা কিছু বুঝতেও পারছেন। তবে তলিয়ে বুঝতে তাঁর একটু ভয় ভয় করছে। ম্যাজিক দেখাতে ধরে আনা হয়েছে বুড়ো ভজহরিকেই।
ম্যাজিক শুরু করার আগে ভজহরি স্টেজের পেছনে পরদার আড়ালে সাজগোজ করতে গিয়ে টের পেল তার হাত-পা ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। বহুকাল পরে তার নিয়তি কেন তাকে এখানে টেনে আনল তা সে বুঝতে পারছিল না। আরও ভয়ের কথা হল, কুমার বাহাদুরকে তার ভারী চেনা চেনা ঠেকছিল। বছর পাঁচেক আগে ভজহরির একজন সহকারী ছিল। তার নাম বৃন্দাবন। ভারী ভাল হাত ছিল বৃন্দাবনের। এক লহমায় শক্ত শক্ত খেলা শিখে ফেলত। বুদ্ধিও ছিল তুখোড়। খুব বিশ্বাসী ছিল বলে ভজহরি তাকে নিজের জীবনের অনেক কাহিনী শুনিয়েছিল। কিছুদিন ভজহরির চেলাগিরি করে একদিন সে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।
আজ কুমার বাহাদুরকে দেখে হঠাৎ বৃন্দাবন’ বলে ডেকে ফেলায় সে কী বিপত্তি! কুমার বাহাদুর এমন রক্ত-জলকরা চোখে চেয়ে রইলেন যে, ভজহরির বুক হিম হয়ে গেল। কুমার বাহাদুরের স্যাঙাতেরা তো এই মারে কি সেই মারে। হাতজোড় করে ক্ষমাটমা চেয়ে তবে রেহাই পায়।
বুকটা বড় ঢিপ ঢিপ করছে ভজহরির। বহুকাল আগেকার সেই ম্যাজিক শো দেখানোর স্মৃতি ফিরে আসছে বার বার। তাতে ভজহরির শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, জল তেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু উপায়ও নেই। কুমার বাহাদুরের হুকুম হয়েছে সেই রাতে ভজহরি যেসব খেলা দেখিয়েছিল সেগুলোই দেখাতে হবে।
সাড়ে ছ’টায় ম্যাজিক শো শুরু হল। ভজহরি টুপি থেকে খরগোশ বের করার খেলাটা দেখাতে দেখাতে আড়চোখে লক্ষ করল বাঁ ধারের চেয়ারগুলো এখনও ফাঁকা। কোনও রাজা মহারাজাকে দেখা যাচ্ছে না।
এরপর দড়ির খেলা, তাসের খেলা, বলের খেলা। চোখ বেঁধে তির ছুঁড়ে আপেল বিদ্ধ করার খেলাও দেখাতে হল। তফাতের মধ্যে জিমির বদলে এবার লালু আপেল মাথায় নিয়ে দাঁড়াল।
আর আশ্চর্যের বিষয়, আজও অবিকল সেদিনের মতোই পুটুং করে সুতোটা ছিঁড়ে গেল এবং ভজহরি তিরটা সময়মতো আটকাতে পারল না। হাততালির শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি চোখের বাঁধন খুলে ভজহরি দেখল তিরটা ঠিক গিয়ে আপেলটাকে গেঁথে ফেলেছে আর বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে লালু।
খুব ধীরে বাঁ ধারে চোখ ঘুরিয়ে ভজহরি যা দেখল তাতে তার হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার কথা। বারোটা চেয়ারে বারোজন মহারাজ বসে আছেন। গম্ভীর মুখ। কপালে ভ্রুকুটি।
ভজহরি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। দরবার ঘরের বাঁ ধারে সেই সিঁড়ি, সেই দরজা।
তার অবস্থা দেখে হঠাৎ কুমার বাহাদুর উঠে তার কাছে এসে নিচু স্বরে বলল, “কিছু দেখা যাচ্ছে?”
ভজহরি রাজাদের দিকে কম্পিত আঙুল তুলে কেবল বলল, “ওই ওই…”
“ওঁরা কি এসেছেন?”
“হ্যাঁ… হ্যাঁ… ওই তো…”
“সিঁড়ি! দরজা!”
“হ্যাঁ…হ্যাঁ…ওই তো…”
বলতে বলতে হঠাৎ ভজহরির শরীরটা হালকা হয়ে হঠাৎ শূন্যে ভেসে উঠতে লাগল। ভজহরি চেঁচিয়ে উঠল, “না…না…আর নয়…”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! ভজহরি পাখির মতো দরবার ঘরের ভেতরে শূন্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। নামে, ওঠে, নামে, পাক খায়। আর ভজহরি চেঁচায়, “আর না…আর না…”
সবাই তাজ্জব হয়ে হাঁ করে এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখছে।
একসময়ে ফের ভজহরি ধীরে নেমে এল তার জায়গায়। মুখ বিবর্ণ, শরীর কাঁপছে।