গাড়োয়ান বলল, “এ হল গঙ্গাধরপুর। আর এটা হল রাজবাড়ি।”
কালকের সেই দশাসই লোকটা হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলল, “আসুন ভজহরিবাবু, আসুন। আমাদের সৌভাগ্য।”
ভজহরি সভয়ে বলল, “আমি এখানে কেন?”
“এখানে না এসে যে আপনার উপায় ছিল না ভজহরিবাবু। সেই খেলাটা আর একবার দেখাতে হবে যে!”
৮. রাজবাড়ির ফটকের উলটোদিকে
রাজবাড়ির ফটকের উলটোদিকে বটগাছটার তলায় দিনতিনেক হল একজন সাধু এসে থানা গেড়েছে। তা সাধুসজ্জন মাঝে মাঝে আসে বটে, অভিনব কিছু নয়। রাজা মহেন্দ্র চোখে ভাল ঠাহর পান। দূর থেকে দেখে যা মনে হয়, সাধুর বয়স খুব কম। কালো দাড়ি গোঁফ, কালো জটা। ছিপছিপে গৌরবর্ণ তেজি চেহারা। একজন চেলাও ঘুরঘুর করছে কাছাকাছি।
রানি বিন্ধেশ্বরীও সাধুটিকে জানলা দিয়ে দেখলেন। দেখে বললেন, “আহা, কী কচি বয়সেই ছেলেটা সাধু হয়ে গেছে দেখো। দেখলে মায়া হয়। কোন মায়ের বুক খালি করে বিবাগী হয়েছে কে জানে।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর বুড়ি দাসী সুবালাকে ডেকে বললেন, “ওরে, ওই সাধুকে একটা সিধে দিয়ে আয় তো। আমার নবেন ফিরে এসেছে, বাছার মঙ্গলের জন্য একটু সাধুসেবা করা ভাল।”
সুবালা বলল, “ও বাবা, ও সাধু বড্ড রগচটা। কারও কাছ থেকে কিছু নেয় না। দিতে গেলে তেড়ে আসে।”
“না নিলে না নেবে। তুই তবু নিয়ে গিয়ে দিয়ে দ্যাখ।”
সুবালা সিধে নিয়ে গেল। ফিরে এসে একগাল হেসে বলল, “তোমার কপাল ভাল গো রানিমা। প্রথমটায় চোখ পাকিয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু যেই বললুম রানিমা পাঠিয়েছে অমনি একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল।”
রানিমার চোখ ছলছল করে উঠল, “আহা রে, বোধ হয় মায়ের কথা মনে পড়েছে।”
মহেন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পড়ারই কথা কিনা।”
রানিমাও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “এই শীতে খালি গায়ে বসে থাকে, দেখলে বড় কষ্ট হয়। খুব ইচ্ছে করে একখানা কম্বল দিয়ে আসি।”
মহেন্দ্র বললেন, “তা দিলেই তো হয়।”
রানিমা বললেন “আমাদের আগের অবস্থা থাকলে কি আর দিতাম না! বাড়তি কম্বলই বা কোথায় বলো! একখানা পুরনো বিলিতি কম্বল আছে বটে, তা সেখানা খুব দামি জিনিস। সেটা তো আর দানধ্যানে দেওয়া যায় না! নবেন আবার রাগ করবে। দেওয়া থোওয়া সে বেশি পছন্দ করে না। বলে, দান ধ্যান করে করেই রাজবাড়ির এই দুর্দশা হয়েছে। তা কথাটা মিথ্যে নয় বাপু।”
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “তা বটে! নবেনের বেশ বিষয়বুদ্ধি আছে।”
রানিমা পানের বাটা নিয়ে বসে পান সাজতে সাজতে বললেন, “খুব আছে। বাছার আমার চারদিকে চোখ। কুটোগাছটা এদিক-ওদিক হলেও ঠিক টের পায়। তা এরকমই তো হওয়া ভাল, কী বল?”
“খুব ভাল, খুব ভাল।”
রানিমা পান মুখে দিয়ে বললেন, “বাছার আমার তেজও আছে খুব। তার দাপটে গঙ্গাধরপুরে এখন বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। বজ্জাত লোকগুলো সব ঢিট হয়ে গেছে। শুনলুম খাজনাপত্রও আদায় হচ্ছে ভালই।”
মহেন্দ্র সভয়ে বললেন, “সবাই খাজনা দিচ্ছে বুঝি?”
“তা না দেবে কেন? আমাদেরই রাজত্বে বাস করবে আর আমাদের খাজনা দেবে না তা কি হয়? নবেন তো আর মেনিমুখো নয় তোমার মতো। ন্যায্য খাজনা আদায় করে ছাড়ছে। বলেছে রাজবাড়ির ভোল পালটে দেবে।”
“বাঃ বাঃ, শুনে বড় খুশি হলাম।”
রানিমা পিকদানিতে পানের পিক ফেলে বললেন, “হ্যাঁ গো এই এতদিন বাদে আমাদের নবেন ফিরে এল তাতে তোমার আনন্দ নেই কেন বলো তো! মুখটা সবসময়ে অমন আঁশটে করে রাখ কেন? বলি তুমি এখনও সেই জডুলটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ নাকি?”
“আরে রামোঃ, জডুল আবার একটা মাথা ঘামানোর মতো জিনিস হল!”
রানি খুশি হয়ে বললেন, “তাই বলো। খবরদার, ওই চোরটাকে আর আশকারা দিয়ো না। ভারী বেয়াদপ লোক। নবেন জানতে পারলে খুব রাগ করবে।”
.
আজ সকালে রাজকুমার নবেন্দ্র তার দলবল নিয়ে ঝিকরগাছার হাটে গেছে। বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য রয়ে গেছে মাত্র দু’জন ষণ্ডা। তবে তারা পদসেবা করতে তেমন আগ্রহী নয় দেখে রাজা মহেন্দ্র ভারী স্বস্তি বোধ করলেন এবং দরবার ঘরে সিংহাসনে বসে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে লাগলেন।
“পেন্নাম হই রাজামশাই।”
মহেন্দ্র চোখ চেয়ে শ্রীদামকে দেখে একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “বুড়ো বয়সের কী দোষ জান! যখন-তখন ঘুম পেয়ে যায়।”
“যে আজ্ঞে! তা বয়সেরও তো গাছপাথর নেই আপনার। এই মাঘে আপনার বয়স গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আটান্ন বছর তিন মাস।”
“আটান্ন! বলো কী হে! আমার তো মনে হয় একানব্বই পেরিয়ে এবার বিরানব্বইতে পা দেব।”
“আপনি যদি হুকুম করেন তো তাই। তবে আমার কাছে পাকা হিসেব আছে মহারাজ।”
মহেন্দ্র একটু ভাবিত হলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “দু-চার বছর কমাতে পার, কিছু মনে করব না। কিন্তু আটান্নটা যে বেজায় কম হে!”
শ্রীদাম হাত কচলে বলে, “তা আটান্ন বয়সটা আপনার পছন্দ না হলে পছন্দমতো একটা বয়স বেছে নিতে বাধা কী মহারাজ! বয়সের ঘাড়ে ক’টা মাথা!”
মহেন্দ্র গভীর চিন্তা করতে করতে বললেন, “বেজায় মুশকিলে ফেলে দিলে হে! দিব্যি বিরানব্বই বছরে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছি, তুমি এসে এক ঝটকায় আটান্নয় নামিয়ে দিলে! এত টানাহ্যাঁচড়া আমার সইবে না বাপু! তোমার দোষ কী জান?”
“আজ্ঞে, দোষঘাটের অভাব কী? আমার শত্রুও বলতে পারবে না যে, শ্রীদামের এই দোষটা নেই।”