ভজহরি চোখটা নামিয়ে নিয়ে মিনমিন করে বলল, “তা হবে হয়তো! কত জায়গাতেই তো খেলা দেখিয়েছি!”
“সে যাই হোক, কুমার বাহাদুরের খুব ইচ্ছে আপনি আর একবার গঙ্গাধরপুরের রাজবাড়িতে খেলা দেখাবেন। এই যে, এই দুশো টাকা আগাম রাখুন। খেলা দেখানোর পর আরও হাজার টাকা।”
ভজহরি হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বলল, “না মশাই, এখন বয়স হয়েছে, আর ছোটাছুটি পোয় না। কুমার বাহাদুরকে আমার নমস্কার জানাবেন। আমি এবার রিটায়ার করব। আমাকে ছেড়ে দিন।”
লোকটা মৃদু হেসে বলল, “তাই কি হয়? কুমার বাহাদুর যা ইচ্ছে করেন তা না করে ছাড়েন না। আপনি গুণী মানুষ, এই হাটে বাজারে তাঁবু খাঁটিয়ে খেলা দেখানো কি আপনার কাজ! কুমার বাহাদুরকে খুশি করতে পারলে আপনার বরাত খুলে যাবে।”
ভজহরি মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, না। আমি পেরে উঠব না। আমাকে মাফ করবেন।”
“কুমার বাহাদুরের অনুরোধটা রাখলে ভাল করতেন।” বলে লোকটা চলে গেল।
লালু আর নদুয়া বলে উঠল, “এঃ ওস্তাদজি, ভাল দাঁওটা ছেড়ে দিলেন!”
ভজহরি জবাব দিল না। তার মনটা বড় খারাপ লাগছে। ঘণ্টাখানেক বাদে দুটো গোরুর গাড়িতে জিনিসপত্র চাপিয়ে তারা রওনা হয়ে পড়ল। সামনের গাড়িতে ভজহরি, পিছনেরটায় লালু আর নদুয়া। ভজহরির গ্রাম কাছেই। এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা।
ভজহরি গোরুর গাড়ির ছইয়ের মধ্যে শুয়ে চোখ বুজে নানা কথা ভাবছিল। মোহরের লোভ যে কী সাঙ্ঘাতিক তা ভজহরি ভালই জানে। বহু বছর আগে গঙ্গাধরপুরের রাজবাড়িতে খেলা দেখাতে গিয়ে তার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে স্পষ্ট দেখেছিল, বারোজন রাজা ঝলমলে পোশাক পরে দরবার ঘরের আসরের বাঁ দিকটায় বসে তার খেলা দেখছেন। যেসব খেলা সেদিন সে দেখিয়েছিল সেইসব খেলার অনেকগুলোই ভজহরির নয়। কোনও প্রেতাত্মা সেদিন ভর করে থাকবে তার ওপর। খেলা শেষ হওয়ার পর একে একে উঠে এসে তাকে একটা করে মোহর বকশিশও দিয়ে গেলেন তাঁরা। তারপর দরবার ঘরের বাঁ দিকে একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। একটা ভারী বাহারি নকশাদার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। স্বচক্ষে দেখা। কিন্তু পরে দেখা গেল, সব অদৃশ্য। সিঁড়ি নেই, দরজা নেই। একজন রাজকুমার তাকে বললেন, “আসরে নাকি কোনও রাজাগজাও ছিলেন না।” ভজহরি এত অবাক হয়েছিল যে বলার নয়।
পরে অনেক রাতে বাড়ির এক আধপাগলা বুড়ো চাকর এসে তাকে চুপি চুপি বলে, “তেনাদের আর কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু আমি পাই।”
“ওঁরা কারা?”
“সে তোমার শুনে কাজ নেই। মোহর তো পেয়েছ, এবার সরে পড়ো।”
“ওঁদের বুঝি অনেক মোহর আছে?”
“মেল মোহর হে, মেলা মোহর। আমাকেও দেন যে, এই অ্যাত মোহর। মোহরের বাক্স মাথায় দিয়েই তো আমি শুই, কেউ জানে না।”
পরদিন ভোরবেলাতেই সরে পড়ল ভজহরি, তারপর মোহর ভাঙিয়ে মেলা টাকা পেয়ে ক’দিন খুব ফুর্তি করে বেড়াল। জলের মতো বেরিয়ে গেল টাকা।
মাসছয়েক বাদে আবার টানাটানি শুরু হল। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। তখন ধীরে ধীরে শয়তান ভর করল মাথায়। বুড়ো চাকরটা না বলেছিল তার কাছে অনেক মোহর! মোহরের বালিশে মাথা রেখে শোয়।
মাথার ওই শয়তানই একদিন ভজহরিকে ফের টেনে নিয়ে গেল গঙ্গাধরপুরে। নিশুত রাতে রাজবাড়িতে ঢুকতে তার অসুবিধেও হল
কিছু। ম্যাজিশিয়ানরা অনেক কৌশল জানে।
দরবার ঘরের এক কোণে চাকরটা শুয়েছিল। ভজহরি গিয়ে তার মাথার তলা থেকে বাক্সটা সরিয়ে ওই মাপের একটা বাক্স খুঁজে দিতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সময়ে চাকরটা হঠাৎ জেগে তাকে জাপটে ধরে ‘চোর চোর’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। ভজহরি দেখল, তীরে এসে তরী ডুবে আর কী! সে চট করে বালিশটা তুলে চাকরটার মুখে ঠেসে ধরেছিল। বুড়ো মানুষটা এক মিনিটের মধ্যেই নেতিয়ে পড়ে গেল। ভজহরি আর দাঁড়ায়নি।
গোরুর গাড়ির দুলুনিতে একটু তন্দ্রা এসেছিল ভজহরির। হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙে গাড়োয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কী রে, এত দেরি হচ্ছে কেন?”
গাড়োয়ান বলল, “রাস্তা খারাপ আছে বাবুমশাই, একটু ঘুরে যাচ্ছি।”
ভজহরি আবার চোখ বুজল। গঙ্গাধরপুরের কথা মনে পড়তে মনটা বড় ভার হয়ে যায়। ভয় ভয় করে। খুনটা কেউ টের পায়নি বটে, পুলিশও ধরতে আসেনি, তবু বড় গ্লানি হয়। বাক্সটা চুরি করেছিল বটে, কিন্তু তার ভোগে লাগেনি। যেদিন বাক্স নিয়ে বাড়ি ফিরল সেদিন রাতেই তার বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। মোহরের বাক্সসমেত সবকিছু নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। ভজহরি পাগলের মতো ডাকাতদের পিছু ধাওয়া করেছিল।
পরে জানা গিয়েছিল, সেই ডাকাতদলটা নিজেদের মধ্যেই মারপিট করে এ-ওর হাতে জখম হয়ে মারা যায়। খালধারে পড়ে ছিল সবকটা। মোহরের বাক্স ফের উধাও। তারপর কী হয়েছে তা আর জানে না ভজহরি। জেনে আর কী হবে! দিন ফুরিয়ে আসছে।
ভজহরি চটকা ভেঙে বলল, “কী রে, আর কত দূর! এ যে রাত ভোর করতে চললি।”
“এসে গেছি কর্তা, আর একটুখানি পথ।”
ভজহরি ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন জাগল তখন ভজহরি অবাক হয়ে দেখল, চারদিকে আলো ফুটি ফুটি। ভোর হচ্ছে। গাড়িও থেমেছে। গাড়োয়ান গাড়ি থেকে নেমে গোরুদুটোকে খুলে দিয়ে বলল, “নামুন কর্তা, এসে গেছি।”
ভজহরি অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে বলল, “এ কোথায় এনে ফেললি! এ তো আমার গাঁ গৌরীপুর নয়।”