হাদু ফের চাপা উত্তেজিত গলায় বলে, “দু’হাতে ক’খানা আংটি দেখেছেন? তার ওপর গলায় সোনার চেন, হাতে সোনার ঘড়ি!”
বিরস মুখে রসো বলে, “দেখেছি রে, দেখেছি। যা দেখা যাচ্ছে না তাও দেখেছি।”
“কী দেখলেন?”
“বাঁ পকেটে অন্তত কয়েক হাজার টাকা আছে।”
“কী করে বুঝলেন?”
“ওরে, দেখে দেখে চোখ পেকে গেছে কিনা।”
বাস্তবিকই তাই। লোকটা চারদিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ বাঁ পকেট থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট বের করে ভ্রূ কুঁচকে একটু দেখলে, তারপর লোকে যেমন বইয়ের পাতা ফরফর করে উলটে যায় তেমনি উলটে গেল। ফের পকেটে রেখে দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে চারদিকে দেখতে লাগল।
হাঁদু চাপা গলায় বলে, “এবার চলুন।”
রসো সভয়ে বলে, “কোথায় যাব?”
“আমি গিয়ে লোকটাকে পেছন থেকে লেঙ্গি মেরে ফেলে দিয়ে পালাব, আপনি দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে ধরে তুলে ধুলোটুলো ঝেড়ে দেবেন। আর সেই ফাঁকে–”
পাগল আর কাকে বলে! দশাসই ওই লোকটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার মতো এলেম ছোটখাটো চেহারার হাঁদুর যে নেই সেটা রসোর চেয়ে ভাল আর কে জানে। কিন্তু ছেলেমানুষ, কিছু করার জন্য ভারী ছটফট করতে লেগেছে। বাধা পেলে বিগড়েই যাবে হয়তো। তাই অনিচ্ছে সত্ত্বেও রসো বলল, “চল তা হলে!”
কিন্তু এক কদম এগোতে-না-এগোতেই রসোর ডান পাঁজরে কে যেন একখানা পেল্লায় কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, “খবরদার!”
গুতোর চোটে ককিয়ে উঠল রসো, “বাবা রে!” ঠিক একই সঙ্গে কে যেন পেছন থেকে একখানা ল্যাং মেরে হাদুকে ফেলে দিল মাটিতে। হাদু পড়ে গিয়ে চেঁচাল, ভূমিকম্প হচ্ছে! ভূমিকম্প!
পেছন থেকে একটি সরু গলা রসোর কানের কাছে বলে উঠল, “খবরদার! ওটির দিকে নজর দিয়ো না। গত আধ ঘণ্টা ধরে আমি ওটাকে তাক করে রেখেছি। যদি ভাল চাও তো সরে পড়ো।”
ঘাড় ঘুরিয়ে রসো যাকে দেখল তাকে দেখে অনেকেরই রক্ত জল হয়ে যায়। সাতহাটির দুর্গা মালো। খুনজখম দুর্গার কাছে জলভাত। লাঠি সড়কিতে পাকা হাত, গায়ে অসুরের জোর। তার ওপর তার দলবলও আছে।
রসো সেঁতো হাসি হেসে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তা আগে বলতে হয় রে ভাই। তোমার জিনিস জানলে কি আর ওদিকপানে তাকাই?”
হৃদু উঠে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে নিতান্তই নির্লজ্জের মতো হাত কচলে দুর্গাকে বলল, “ওস্তাদজি, কতদিন ধরে আপনার পায়ে একটু ঠাঁই পাব বলে বসে আছি। অধমকে যদি একটু ঠাই দেন…”
দুর্গা মালো চাপা একটা ফুঁ দিয়ে বলল, “যাঃ ব্যাটা তিনফুটিয়া, আমার দলে ঢুকতে হলে আগে বুকের ছাতি আর হাতের গুলি চাই, বুঝলি! এসব তোর কম্ম নয়। রসোর শাগরেদি করছিস তাই কর।”
হাদুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে এল রসো। আড়ালে এসে চুপিচুপি বলল, “ছিঃ ঘঁদু, এত অল্পেই হাল ছেড়ে দিলি? হুট করে গুরু বদলালে পাপ হয়, তা জানিস?”
হাঁদু হেঁদানো গলায় বলে, “তা কী করব মশাই, আপনার কাছে থেকে যে আমার কোনও উন্নতিই হচ্ছে না! আমাকে তো আখেরটা নিয়ে ভাবতে হবে নাকি?”
“অত সহজে হাল ছেড়ে দিস না। দুর্গা মালোর সঙ্গে টক্কর দিয়ে লাভ নেই। আয়, দু’জনে তক্কে তক্কে থাকি। দুর্গা হাতের সূক্ষ্ম কাজ কারবার জানে না। ওর হল মোটা দাগের হুডুম দুড়ুম কাজ। হাটের মধ্যে ওসব করার অসুবিধে আছে। আয়, আমরা বরং লোকটাকে দূর থেকে চোখে চোখে রাখি। ওর একখানা আংটির দামই পাঁচ-সাত হাজার টাকা।”
হাদু বিরস মুখে বলে, “কিন্তু মানুষের শরীর বলে কথা। ঘোরাঘুরিতে যে খিদেও পেয়ে গেল মশাই।”
“হবে হবে, সব হবে। খিদে-তেষ্টাকে জয় না করতে পারলে এ লাইনে কি টেকা যায় রে! মুনিঋষিদের কথা শুনিসনি? না খেয়ে তপস্যা করতে করতে পেটে পিঠে এক হয়ে যেত! চল বরং দুখিরামের দোকান থেকে দুটো গরম চপ খেয়ে নিবি।
জাদুকর ভজহরি বিশ্বাস ঝিকরগাছার হাটে ম্যাজিক দেখাচ্ছে কম করেও ত্রিশ বছর। আগে ম্যাজিক দেখতে লোক ভেঙে পড়ত। তাবুতে জায়গা হত না। ঝিকরগাছার হাট থেকে একদিনে তার দু-তিনশো টাকা আয় হত। কিন্তু সেইসব সুদিন আর নেই। দু’ টাকার টিকিট কেটেও কেউ আজকাল ম্যাজিকের তাঁবুতে ঢোকে না বড় একটা।
ছেঁড়া তাবুতে শতেক তাপ্পি লাগাতে হয়েছে। ভজহরির জরির ঝলমলে পোশাকেরও আর জলুস নেই। পোশাকেও মেলা তালি আর রিপু। মাথার পাগড়িখানার রং চটে গেছে। ভজহরির এখন পায়ে গেঁটে বাত, মাথায় টাক, মুখ প্রায় ফোকলা। যৌবনকালে যেসব খেলা দেখাতে পারত তা আর এই বুড়ো বয়সের শরীরে কুলোয় না। দু’জন শাগরেদ আছে তার। লালু আর নদুয়া। আগের অ্যাসিস্ট্যান্টরা এখন নিজেরাই জাদুকর হয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। হাড়হাভাতে লালু আর নদুয়া এসে জুটেছে পেটের দায়ে। খেলা শেখায় তাদের মনও নেই, মাথাও নেই। তবু তারাও দু-চারটে এলেবেলে খেলা দেখায় বটে। কিন্তু লোকে আজকাল এসব বস্তাপচা পুরনো খেলা পছন্দ করে না।
তবু ভজহরি ফি-হাটবারে দুটো করে শো দেখায়। বেলা একটা থেকে তিনটে। সাড়ে তিনটে থেকে সাড়ে পাঁচটা। তাইতেই তার হাঁফ ধরে যায়।
নুন শোতে আজ লোক হয়েছিল সাকুল্যে বারোজন। খরচ তো উঠবেই না, উপরন্তু লোকসানই দিতে হবে। বিকেলের শোর আগে ভজহরি ভেতরে বসে জিরোচ্ছিল। বাইরে চেয়ারে বসে নদুয়া টিকিট বিক্রি করছে আর চেঁচিয়ে লোক জড়ো করার চেষ্টা করছে। ভজহরি ভাবছিল, এবার খেলা দেখানো ছেড়েই দেব। পরিশ্রম আর খরচ কোনওটাতেই পোষাচ্ছে না।